নজর কেবল ক্ষমতায়, থমকে উন্নয়ন

অনাস্থা ও দলবদলের রাজনীতির জেরে অল্প সময়ের মধ্যে একের পর এক পুরপ্রধান এসেছে গিয়েছে। তা নিয়ে নানা মুখরোচক জল্পনায় চায়ের কাপে তুফান উঠেছে। তোলপাড় হয়েছে স্থানীয় রাজনীতি। এ সব চাপানউতোরের মাঝে খারাপ থেকে আরও খারাপ হয়েছে ধুলিয়ানের পুর-পরিষেবা। অভিযোগ, ধুলিয়ান পুর এলাকার নিকাশি, পানীয় জল, যানজটের মতো একাধিক সমস্যার হাল ফেরাতে তেমন সক্রিয় হননি কোনও পুরপ্রধানই। ফলে সমস্যা দিন দিন বেড়েছে।

Advertisement

বিমান হাজরা

রঘুনাথগঞ্জ শেষ আপডেট: ২৫ মে ২০১৫ ০১:৫১
Share:

অনাস্থা ও দলবদলের রাজনীতির জেরে অল্প সময়ের মধ্যে একের পর এক পুরপ্রধান এসেছে গিয়েছে। তা নিয়ে নানা মুখরোচক জল্পনায় চায়ের কাপে তুফান উঠেছে। তোলপাড় হয়েছে স্থানীয় রাজনীতি। এ সব চাপানউতোরের মাঝে খারাপ থেকে আরও খারাপ হয়েছে ধুলিয়ানের পুর-পরিষেবা। অভিযোগ, ধুলিয়ান পুর এলাকার নিকাশি, পানীয় জল, যানজটের মতো একাধিক সমস্যার হাল ফেরাতে তেমন সক্রিয় হননি কোনও পুরপ্রধানই। ফলে সমস্যা দিন দিন বেড়েছে। পুরবাসীর একটা বড় অংশের অভিযোগ, ‘‘সকলের লক্ষ্য যে কোনও উপায়ে পুরসভার ক্ষমতা দখল। পুর-পরিষেবার দিকে নজর দেওয়ার ফুরসৎ কোথায়?’’

Advertisement

শহরের পরিষেবা নিয়ে পুরবাসীর বিস্তর অভিযোগের মধ্যেই গত বৃহস্পতিবার পুরপ্রধান হিসেবে শপথ নিয়েছেন সুবল সাহা। তিনি বিজেপি-র টিকিটে জিতে রাতারাতি তৃণমূলে নাম লিখিয়েছেন। দলবদলের দুর্নাম যেমন তাঁর উপরে রয়েছে, তেমন দলের মধ্যেই পুরপ্রধান পদ নিয়ে থেকে গিয়েছে ক্ষোভ। এর পরিণতি কী হতে পারে তার সর্বশেষ নজির প্রাক্তন পুরপ্রধান তরুণকান্তি সেন। যিনি ফরওয়ার্ড ব্লক থেকে তৃণমূলে ভিড়ে পুরপ্রধান হয়েছিলেন। ৭ মাস ২ দিনের মাথায় কার্যত গলাধাক্কা দিয়ে তাঁকে পদ থেকে সরানো হয়।

ধুলিয়ানের রাজনীতিতে এটাই দস্তুর। ২০১০ থেকে ২০১৫—এই ৫ বছরে চার চার বার পুরপ্রধান বদলেছে ধুলিয়ানে। গত ২০ বছরে এই সংখ্যাটা ১৪। এই আবহে নতুন পুরপ্রধান কেমন কাজ করতে পারেন সে দিকেই চেয়ে ধুলিয়ানবাসী। তাঁদের একাংশের মত, ঘন ঘন পুরপ্রধান পদে রদবদলে ধুলিয়ানের উন্নয়নের গতি থমকে গিয়েছে। বিজেপি থেকে তৃণমূলে যোগ দেওয়া সুবলবাবু অবশ্য পুর পরিষেবার হাল ফেরানোর ব্যাপারে আশাবাদী। তিনি শহরের উন্নয়নের প্রশ্নে নানা পরিকল্পনার কথাও শুনিয়েছেন।

Advertisement

মুর্শিদাবাদের আর পাঁচটা পুর-শহরের উন্নয়নের তুলনামূলক বিচারেও পিছিয়ে ধুলিয়ান। জঙ্গিপুরে বামেরা দীর্ঘ তিন দশক, বহরমপুরে কংগ্রেস কয়েক যুগ হল ক্ষমতায় রয়েছে। দু’টি দলই রাজ্যের বর্তমান শাসক দল তৃণমূলের বিরোধী। অথচ ১৯০৯ সালে পুর শহরের মর্যাদা পাওয়া ধুলিয়ান শতবর্ষ অতিক্রমের পরেও ৬০ শতাংশ এলাকায় আজও নিকাশী ব্যবস্থার নাগালের বাইরে। ৮০ শতাংশ এলাকার বাসিন্দারা পরিশ্রুত পানীয় জল থেকে বঞ্চিত। ধুলিয়ানে এখন জনবসতির সংখ্যা বেড়ে ১.০৫ লক্ষ ছাড়িয়েছে। জনসংখ্যার ৭৪ শতাংশই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। জনপদের এই বিশাল বৃদ্ধি এমনিতেই ধুলিয়ান শহরের কাছে বোঝার মতো। তার উপরে জেলার অন্য শহরগুলির চেয়ে ধুলিয়ানের চেহারাটা ভীষণ ভাবে অবিন্যস্ত, অপরিকল্পিত।

শহর জুড়ে আজও রয়েছে ঘোড়ার গাড়ির দূষণ, জবরদখলের যন্ত্রণা, নিকাশী সমস্যা ও পানীয় জলের হাহাকার। ধুলিয়ানের গা ঘেঁষে বয়ে গিয়েছে গঙ্গা। অথচ সেই ধুলিয়ানেই মেলে না পরিশ্রুত পানীয় জল। ৪৮ বছর আগে পুর ভবনের পাশেই তৈরি হয়েছিল ভুগর্ভস্থ পানীয় জলের প্রকল্প। তখন ওয়ার্ড ছিল ৯টি। এখন ওয়ার্ড বেড়ে হয়েছে ২১টি। পানীয় জলের জোগান বলতে এক লক্ষ গ্যালনের বহু পুরোনো সেই জল প্রকল্পটি। ভুগর্ভ থেকে তোলা জল পাইপলাইনের মাধ্যমে মাত্র ৬টি ওয়ার্ডের মাত্র ২০ শতাংশ মানুষের কাছে পৌঁছয়। বাকি ৮০ শতাংশ বাসিন্দার ভরসা নলকুপের জল। সেই নলকুপের চারপাশেও দুর্গন্ধময় আবর্জনার স্তুপ। সে জলেও মিশে রয়েছে ভুগর্ভের বিষ। বছর ১৫ আগে ধুলিয়ানের জলে আর্সেনিকের মাত্রা ধরা পড়ে .০৯ মিলিগ্রাম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ‘হু’-র মতে মানুষের শরীরে আর্সেনিকের সহন ক্ষমতা .০১ মিলিগ্রাম। একটু বৃষ্টিতেই জল জমার সমস্যা রয়েছে কমবেশি ৬টি ওয়ার্ডে। এক সময় পাম্প চালিয়ে সে জল বের করার ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু চার দিকে বসতি গড়ে ওঠায় তা শিকেয় উঠেছে।

স্থানীয়দের অভিযোগ, সেই সব সমস্যা সমাধানের চেয়ে ক্ষমতা দখলের রাজনীতিই প্রধান হয়েছে। তাই নির্বাচনে জেতার এক সপ্তাহ যেতে না যেতেই ফের দলবদল! তৃণমূলের জেলা সভাপতি মান্নান হোসেনের সাফাই, ‘‘আমরা তো কাউকে দল থেকে ভাঙিয়ে আনিনি। ওরা উন্নয়নের স্বার্থেই এসেছেন।’’ শহরের বড় ব্যবসায়ী তথা সদ্য নির্বাচিত ধুলিয়ানের পুরপ্রধান সুবল সাহা পুরভোটে দাঁড়ানো তো দূরের কথা কোনও দিনই কোনও রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকেননি। এ বারই প্রথম বিজেপি-র টিকিটে দাঁড়িয়ে জয়ী হয়েই পুরপ্রধান পদে নির্বাচিত হয়েছেন তৃণমূলের বদান্যতায়!

পুরপ্রধান হিসেবে শপথ গ্রহণের পরে তাঁর প্রতিশ্রুতি, ‘‘শহরের নিকাশী ব্যবস্থা ঢেলে সাজাব। পানীয় জলের সমস্যার সমাধানে নির্মীয়মান জল প্রকল্পটির কাজ দ্রুত করায় নজর দেব।’’ সুবলবাবু নিজেও জানেন না যে তার আয়ু কত দিন। ঘাড়ের কাছেই নিঃশ্বাস পড়ছে পুরপ্রধান পদে দাবিদার আমরুল মহলদার, প্রশান্ত সরকারদের! আমরুল তো পুরপ্রধান পদে সুবলবাবুর নাম শুনে অনশনে বসেছিলেন। প্রশান্তবাবু বোর্ড গঠনের সভা থেকে বেরিয়ে তৃণমূলের বিজয় সভায় না গিয়ে বাড়ির পথ ধরেছিলেন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement