ধর বাড়ির প্রতিমা। নীচে, এই পুথি দেখেই পুজো হয়। —ফাইল চিত্র।
ঠাঁয় বদল হয়েছে বারবার। কিন্তু, প্রায় তিনশো বছরের ঐতিহ্যে কোনও ভাটা পড়েনি। দেশভাগ থেকে শুরু করে বহু ঝড় বয়ে গিয়েছে সাবেক বাংলার ধর পরিবারের উপর দিয়ে। কিন্তু, এক বারের জন্যও ভাটা পড়েনি পুজোতে। ধর পরিবারের দুর্গা শান্তির দেবী রূপে পূজিতা হন। পুজোর মুখে দেশের আকাশে যখন যুদ্ধের দামামা, তখন ধরবাড়ির দ্বিভুজা দেবী শান্তির আগমন বার্তা বয়ে আনছেন বলে মনে করছেন ধর পরিবারের সদস্যরা।
ঢাকার বিক্রমপুরের চিত্রকোটে শুরু হয়েছিল এই পুজো। পরে সরে যায় নারায়নগঞ্জে। দেশভাগের পর দেশ ছাড়ে ধর পরিবার। তাঁদের সঙ্গে ১৯৪৯ সালে এই পুজো চলে আসে এ পার বাংলায়। ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত কলকাতায় ধর পরিবারের বিভিন্ন বাড়িতে পুজো হয়েছে। ১৯৭৬ সালে উত্তর ২৪ পরগনার অশোকনগরে এই পুজো শুরু হয়। এতদিন সেখানেই চলছিল পুজো। এ বছর থেকে এই পুজো শুরু হল কল্যাণীর ধর বাড়িতে। ধর পরিবারের সদস্যরা বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছেন। তাঁরাই আলোচনা করে পুজোর বিষয়ে সমস্ত সিদ্ধান্ত নেন।
পরিবারের সদস্য কল্যাণীর এফ ব্লকের বাসিন্দা পলাশ ধর জানালেন, তাঁদের পুর্বপুরুষরা ঢাকার বিক্রমপুর চিত্রকোটের বাসিন্দা ছিলেন। তাঁদের পরিবার সেখানে মুন্সি পরিবার বলে পরিচিত ছিল। পরিবারের কর্তা কাশীনাথ ধর এই পুজো শুরু করেছিলেন। প্রথমে দেবী দশভুজাই পূজিতা হতেন। দীর্ঘদিন তেমনটাই হয়ে এসেছে। তখন পুজোতে বলি হত।
এক বছর পুজোতে বলি আটকে যায়। সেই রাতেই কাশীনাথ মায়ের স্বপ্নাদেশ পান। স্বপ্নে তিনি বলেন, শক্তির দেবী রূপে পূজিতা হতে চান না আর। রণচন্ডী মূর্তির বদলে তাঁর মাতৃ মূর্তির পুজো হোক। স্বপ্নাদেশের পর চিন্তায় পড়েন কাশীনাথ। পুজার আচার-উপাচারও যদিও স্বপ্নেই জেনেছিলেন তিনি। দেবীর মাতৃ মূর্তির পুজোর কোনও চল নেই বলে নিজের নায়েবকে কাশীনাথ কাশী পাঠান।
কাশীর দশাশ্বমেধ ঘাটে তিনি যখন বসে ছিলেন, সেই সময় এক বালিকা তাঁর হাত ধরে এক পূজারীর কাছে নিয়ে যায়। তাঁর কাছ থেকে দেবীর মাতৃমূর্তির পুজোর বিষয়ে খুঁটিনাটি জেনে নেন। সেই পূজারী কাশীনাথের নায়েবকে পূজা পাঠের জন্য একটি তালপাতার পূঁথি উপহার দেন। সেই পূঁথি নিয়ে তিন মাস পর বাড়ি ফেরেন নায়েব মশাই। পরের বছর থেকে শুরু হয় দেবীর মাতৃমূর্তির পুজো। তবে কবে থেকে দেবীর মাতৃ মূর্তির পুজোর প্রচলন, তা সঠিকভাবে জানা যায় না।
ধর বাড়ির দুর্গা দ্বিভূজা। বাহন সিংহের উপরই তার অধিষ্ঠান। তিনি দ্বিভুজা। কোলে পুত্র গণেশ। এক পাশে লক্ষ্মী, অন্যপাশে সরস্বতী। এক হাতে গণেশকে ধরে রয়েছেন দেবী। অন্যহাতে বরাভয় মূদ্রা। দেবী যেহেতু শান্তির দূত, তাই এখানে দেবীর কনিষ্ঠ পুত্র, দেব সেনাপতি কার্তিকের ঠাঁই হয়নি। ঠাঁয় জোটেনি অসুরেরও।
দাবাড়ু, গ্র্যান্ড মাস্টার সহেলী ধর বড়ুয়া এই পরিবারের সদস্য। যেখানেই পুজো হোক না, প্রতি বছরই স্বামীকে দিব্যেন্দু বড়ুয়াকে নিয়ে তিনি পুজোয় হাজির থাকেন বলে জানালেন পলাশবাবু। এ বারও বাড়ি আসবেন বলে জানালেন তিনি। পুজোকে কেন্দ্র করে প্রতিবারই পরিবারের সকলেই একত্রিত হন। চারদিনই পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।