কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের প্রতিপদ তিথি। গৃহস্থের বাড়ির সামনে পৈড়ান গাড়া উপড়ে তুলতে প্রাণপণ কসরত করছেন গ্রামের খেত মজুররা। বাজছে ঢোল, মাদল, নাগাড়া। কয়েক দশক আগেও কালীপুজোর পরদিন ‘পৈড়ান’ অনুষ্ঠানটিকে ঘিরে জঙ্গলমহলের গ্রামে উদ্দীপনা ছিল তুঙ্গে।
অনুষ্ঠানে পাটের দড়ি বিনুনির মতো পাকিয়ে গৃহস্থের বাড়ির সামনে মাটিতে অনেকটা গর্ত করে পুঁতে রাখা হয়। এমন ভাবে সেটি মাটির গভীরে পোঁতা থাকে, যাতে সহজে কেউ টেনে বের করতে না পারে। মাটির উপরে থাকা চুলের বিনুনির মতো পাটগাছের দড়িটিতে সাজানো হয় গেঁদাফুল ও পিটুলি বাটা দিয়ে। এক সময় গ্রামের প্রতিটি গৃহস্থবাড়ির সামনে পৈড়ান পোঁতার রেওয়াজ ছিল। বাজনা বাজিয়ে গ্রামের যুবক ও খেত মজুররা পৈড়ান তুলতে আসতেন। যিনি বা যাঁরা পৈড়ান টেনে উপড়ে ফেলতে পারতেন, তাঁদের পুরস্কৃত করা হত। সারা বছর যাঁরা চাষজমিতে মজুরের কাজ করতেন, এই বিশেষ দিনটিতে তাঁরা বীরের সম্মান পেতেন। প্রচলিত বিশ্বাস ছিল, পৈড়ান উপড়ে তুলতে পারলে সেই গৃহস্থের ভাল ফসল হবে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে গিয়েছে কালীপুজো ও দীপাবলি কেন্দ্রিক জঙ্গলমহলের বিচিত্র এই লৌকিক অনুষ্ঠান। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার দুই বিশিষ্ট লোকসংস্কৃতি গবেষক মধুপ দে ও সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “গ্রামের শক্তিশালী যুবকদের স্বীকৃতি-জ্ঞাপনের অনুষ্ঠানটি এখন বিলুপ্তপ্রায়।’’ কালীপুজোর রাত ফুরোলে প্রতিপদের ভোররাতে ‘মশাখেদা’ অনুষ্ঠানটি এখনও হাতে গোনা কয়েকটি এলাকায় হয়। প্রবল শব্দে ক্যানেস্তারা বা টিন পিটিয়ে গ্রাম প্রদক্ষিণ করেন একদল কিশোর-যুবা। বাজনার সঙ্গে বিচিত্র ছড়া কাটা হয়। গবেষকদের বক্তব্য, ক্ষতিকারক পোকামাকড় থেকে জমির ফসল রক্ষা করার উদ্দেশ্যেই এই অনুষ্ঠান হয়। লোকসংস্কৃতি গবেষক মধুপ দে বলেন, “মশাখেদা, পৈড়ান, বাঁদনা এই উৎসব ও লৌকিক বিনোদন অনুষ্ঠানগুলি কৃষি সংস্কৃতির অঙ্গ। গ্রামাঞ্চলের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট দ্রুত বদলাচ্ছে। নাগরিক সংস্কৃতির দাপটে গ্রামীণ সংস্কৃতি বিলুপ্ত হতে বসেছে।” গবেষকদের মতে, লোকপ্রসার প্রকল্পের আওতায় জঙ্গলমহলের বিলুপ্তপ্রায় লৌকিক অনুষ্ঠান গুলির চর্চা ও সংরক্ষণ জরুরি। ঝাড়গ্রাম মহকুমা তথ্য ও সংস্কৃতি আধিকারিক আজিজুর রহমান বলেন, “বিষয়টি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নজরে আনব।”