ত্রিমোহিনীর পথে ঘাটে স্বজনের উদ্বেগে জটলা। বুধবার। নিজস্ব চিত্র
কান্দির পাতেন্দার এলাকার আজিবুর শেখ সাত বছর ধরে সৌদি আরবে কাজ করছেন। ঘরের টানে যখন সব ছেড়ে ফেরার কথা ভাবলেন বেঁকে বসল এজেন্ট— ‘এ বাবে কাজ ছাড়া যাবে না!’ আটকে রাকা হল তাঁর পাসপোর্ট। আইনি জটিলতায় পড়ে ঘরে ফেরাই দুষ্কর হয়ে উঠেছিল তাঁর। আজিবুর বলছেন, ‘‘সে এক পাগল পাগল অবস্তা। মাথাটাই খারাপ হয়ে গিয়েছিল!’’ শেষ পর্যন্ত পাসে পেয়েছিলেন বহরমপুরের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে। গত সপ্তাহে ঘরে ফিরেছেন আজিবুর, বলছেন, ‘‘বিদেশ বিভুঁইয়ে আটকে গেলে কী অসহায় যে লাগে!’’
সেই অসহায়তা আঁকড়েই দাঙ্গা বিধ্বস্ত দিল্লির একটি ছোট্ট ঘরে প্রায় অনাহারে গত তিন ধরে আটকে রয়েছেন জেলার এগারো জন যুবক।
রুজির টানে মুর্শিদাবাদ জেলারবহু মানুষ জেলার বাইরে ঘর-ছাড়া হয়ে দিন কাটাচ্ছেন। সংখ্যাটা কত, তা অবশ্য জেলা প্রশাসনের কাছে হিসেব নেই কোনও। কাশ্মীরে জঙ্গিহানায় বাহালনগরের পাঁচ যুবকের নিহত হওয়ার পরে সে ব্যাপারে উদ্যোগ নিয়েছিল প্রশাসন।
তবে সে কাজ এখন বিশ বাঁও জলে। ফলে কারা কোথায় পেটের দায়ে আটকে আছেন তার কোনও হিসেব নেই কারও কাছে।কোথাও দাঙ্গায় কোথাও বা দুর্যোগে কিংবা ঠিকাদারের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় ঘরে ফিরতে চেয়েও তা আর হয়ে ওঠে না মুর্শিদাবাদের অজস্র শ্রমিকের।
পাতেন্দার আজিবুরের মতো বহরমপুরের এক যুবকও তিন মাস ধরে কার্যত ‘বন্দি’ থাকার পরে বুধবার রাতে দুবাই বিমানবন্দর থেকে বিমান ধরেছেন। ডোমকলের এক যুবক কেরল থেকে ফিরতে চেয়েও পারছেন না আজ এক মাস যাবত।
কাশ্মীরের জঙ্গিহানার সময়ে শ্রমিকদের ঘরে ফেরা থমকে থাকার উদাহরণ টেনে মুর্শিদাবাদের জেলাশাসক জগদীশপ্রসাদ মিনা বলছেন, ‘‘এ জেলার কেউ বাইরে গিয়ে বিপদে পড়েছেন এমন খবর প্রায়ই পেয়ে থাকি। তবে, খবর পেলেই তাঁদের ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করে প্রশাসন, এমন নজিরও রয়েছে।’’
বহরমপুরের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা বিদেশ ও ভিন রাজ্যে কর্মরত শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করে। ওই সংস্থার সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, ‘‘জেলার অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই খারাপ। সামান্য দু-পাঁচশো টাকা বাড়তি আয়ের খোঁজে পরিবার-ঘর-পরিজন ফেলে রোজগারের আশায় এ জেলার বহু লোকজন ভিন রাজ্য বা ভিন দেশে কাজে যান। কিন্তু সেখানে গিয়ে আটকে পড়লে জেলায় তাঁদের দেখার মতো কেউ নেই।’’ তাঁর দাবি, বাড়ির লোকজনকে প্রশাসনের দ্বারে দ্বারে চক্কর খেতে হয়। কিন্তু ফল মেলে না বলেই তাঁর অভিযোগ।
তিনি জানান, এ ব্যাপারে সহযোগীতার জন্য ‘মদত’ নামে বিদেশমন্ত্রকের একটি পোর্টাল রয়েছে। কেউ বিদেশে আটকে আছে খবর পেলে তাদের বিষয়টি ওই পোর্টালে জানানো যায়। এর পরে নিয়মিত যোগাযোগের মাধ্যমে তাঁদের দেশে ফেরানো সম্ভব হয়।
বহরমপুরে রাঙামাটি চাঁদপাড়া, সাটুই-চৌরিগাছা, সাহাজাদপুর ও গোয়ালজান-নিয়াল্লিশপাড়া গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার বহু বাসিন্দা কাজের খোঁজে মধ্য প্রাচ্যের সৌদিআরব, কুয়েত, কাতার, দুবাইয়ে কাজের খোঁজে যান।
ডোমকল, জলঙ্গি, রানিনগর, লালগোলা, ভগবানগোলা, হরিহরপাড়া, কান্দি—বিস্তীর্ণ এলাকার লোকজন রাজমিস্ত্রি থেকে জোগাড়ে, গাড়ির মিস্ত্রি থেকে ছাগল চড়ানো, বিভিন্ন কাজে কেরল, গোয়া-সহ বিভিন্ন রাজ্যে যান। আবার একটু হাতের কাজ জানা লোকেরা দিল্লি, মুম্বই, কাশ্মীরে পাড়ি দেওয়ার ঘটনাও কম নয়।