ছবি পিটিআই।
হরিদ্বারে ট্রেনে ওঠার সময়ে হাতে যে খাবারের প্যাকেট ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তা নাকি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। এতটাই গন্ধ বেরোচ্ছিল যে মুখেই তুলতে পারেনি গয়েশপুরের বাসিন্দা কৃষ্ণেন্দু বিশ্বাস। পরে কিছু স্টেশনে ট্রেন থামলে জল, কেক আর কলা দেওয়া হয়েছিল। ব্যস এই পর্যন্ত। কৃষ্ণনগর স্টেডিয়ামে যখন তাঁদের হাতে টিফিন প্যাকেট তুলে দেওয়া হল তখন রাত প্রায় ন’টা। খিদেয় তখন প্রায় কুঁকড়ে যাচ্ছে শরীরটা।
গভীর রাতে যখন বাড়ি ফিরলেন নৈনিতালের কোয়ান্টাম ইউনিভারসিটিক বিএসসির ওই ছাত্র, তখন গোটা এলাকা ঘুমিয়ে পড়়েছে। মঙ্গলবার হোম কোয়রান্টিন থেকে ফোনে কৃষ্ণেন্দু বলছেন, “খাবার বা ঘুমের কষ্ট সহ্য করে নেওয়া যায়। কিন্তু পারস্পরিক দূরত্ব কোনও ভাবেই রক্ষা করতে পারলাম না। সেটাই যা ভয়ের কারণ।”
১৭ মে বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ প্রায় এগারোশো যাত্রী নিয়ে হরিদ্বার স্টেশন থেকে যাত্রা শুরু করে ১৪ কামরার ট্রেনটি। ১৮ মে, সোমবার ট্রেনটি যখন কৃষ্ণনগর স্টেশনে এসে দাঁড়ায়, তখন রাত প্রায় পৌনে আটটা। সমস্ত পরীক্ষা সেরে বাসে করে যখন যাত্রীরা স্টেশন থেকে স্টেডিয়ামে পৌঁছান, তখন মাঠে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বাসে করে ফেরা প্রচুর মানুষের ভিড়। তাঁদের সঙ্গে যোগ হন ট্রেন যাত্রীরা।
সকলেই ব্যস্ত। কারও যেন আর তর সইছে না। সকলেই কাউন্টারে সামনে আগে গিয়ে দাঁড়়াতে চান। সকলেই চাইছেন, তাঁর এলাকার জন্য নির্দিষ্ট করা বাসে উঠে পড়তে। আর তাতেই পারস্পরিক দূরত্বের বিষয়টা সমান ভাবে রক্ষা যায়নি।
কৃষ্ণেন্দু বলছেন, “মাঠে তখন প্রচুর মানুষের ভিড়। অনেকেই কিন্তু পারস্পরিক দূরত্বের কথা মাথায় রাখতেই চাইছিলেন না।”
ওই ট্রেনে নদিয়ার যাত্রী ছিলেন মাত্র দশ জন। তাঁদের জন্য ছিল না কোনও বাস। অনেক চেষ্টা করার পর একটা গাড়ি পাঁচ জনকে নিয়ে কল্যাণীর দিকে রওনা দেয়। রাত তখন অনেক। জানা গেল, ট্রেনের যাত্রীদের চেয়ে অনেক বেশি ভোগান্তির মধ্যে পড়তে হয়েছে বাসে করে যাঁরা ফিরেছেন, তাঁদেরকে। এ দিনও দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বাসে করে ফিরেছেন নদিয়ার মানুষ। যাঁরা বেশির ভাগই পরিযায়ী শ্রমিক। সোমবার ঝাড়খণ্ড থেকে ফেরেন চিত্রশালীর বাসিন্দা বাবান বৈদ্য। তিনি বলেন, “বেলা তিনটে নাগাদ আমাদের বাস এসে পৌঁছয় স্টেডিয়ামের সামনে। বাসটা বড় হওয়ায় মাঠের ভিতরে ঢুকতে পারেনি। আমাদের বাসটা বাইরে রাস্তার পাশে দাঁড় করানো ছিল।” তিনি জানান, দুপুরের অসম্ভব গরমে বাসের ভিতরে ২৩ জন মানুষ হাঁসফাঁস করছিলেন। তার উপরে পুলিশ বাস থেকে নামতে দেয়নি। বাবান বলছেন, ‘‘খাবার তো দূরের কথা। একটু জল পর্যন্ত পাইনি!”
এর পর রাত আটটা নাগাদ ডাক আসে কাউন্টারের সামনে দাঁড়ানোর জন্য। তার আগে একে একে দিল্লি, মহারাষ্ট্র, চেন্নাই থেকে পরিযায়ী শ্রমিক ভর্তি বাস এসে দাঁড়িয়েছে স্টেডিয়ামে। সকলেই ভীষণ অসহিষ্ণু, সকলেই অন্যের আগে বাড়ি ফিরতে চান। তখন কোথায় আর পারস্পরিক দূরত্ব রক্ষা? বাবান বলছেন, “সকলেই কিন্তু সমান ভাবে দূরত্ব রক্ষা করেনি। কেউ কেউ সব ভুলে ঘোরাফেরা করেছেন।”
বেশ কিছু দিন ধরেই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে জেলায় ফিরছেন পরিযায়ী শ্রমিকেরা। তাঁদেরকে পরীক্ষা করে স্পটেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে, কাকে হোম কোয়রান্টিনে রাখা হবে আর কাকে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়রান্টিনে।
আর সেটা করতে গিয়েই যেন অনেক সময়ই ভেঙে গিয়েছে ধৈর্যের বাঁধ, যার ফল পারস্পরিক দূরত্ব না মানা। এর মাধ্যমে দ্রুত গোষ্ঠী সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকেই। জেলাশাসক বিভু গোয়েল বলছেন, “আমি রাত সাড়ে বারোটা পর্যন্ত মাঠে ছিলাম। আমাদের অফিসারেরা সব কিছু অত্যন্ত সুন্দর ভাবে বাস্তবায়িত করেছেন। কোথাও তেমন কোনও সমস্যা হয়নি।”
তিনি আরও জানান, পারস্পরিক দূরত্বের বিষয়টিও গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়েছে। মানুষের ভিড়েও সমস্যা হয়নি।