Coronavirus

বন্ধ যন্ত্রচালিত তাঁত বোনা, টান পেটে 

সে বার মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে শ্রমিক আন্দোলনের জেরে ১৫ জুলাই থেকে বন্ধ হয়েছিল একের পর এক যন্ত্রচালিত তাঁত। সাতাশ দিনের মাথায় দাবি কিছুটা আদায়ের পর স্বাভাবিক হয়েছিল পরিস্থিতি। সেই কাজ বন্ধের রেশ কাটতে না কাটতেই করোনা ঠেকাতে এই লকডাউন।

Advertisement

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়

নবদ্বীপ শেষ আপডেট: ৩০ মার্চ ২০২০ ০৩:২০
Share:

প্রতীকী ছবি

ছ’মাস আগের চেনা ছবিটা আবার ফিরছে গ্রামীণ নবদ্বীপে। গঙ্গার বিস্তীর্ণ দু’পাড়ে অসংখ্য মানুষের হাহাকার। বিশেষ করে, নদীর পূর্বপাড়ে স্বরূপগঞ্জ, মাজদিয়া-পানশিলা এবং চরমাজদিয়া-চরব্রহ্মনগর পঞ্চায়েতের বিস্তীর্ণ এলাকা গত জুলাই-অগস্ট মাসের মতোই নিস্তব্ধ। বন্ধ হয়ে গিয়েছে পাওয়ার লুমের চাকা। বর্তমানে করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতি যা আকার নিয়েছে, তাতে কবে আবার যন্ত্রচালিত তাঁত বা পাওয়ার লুমের কাজ চালু হবে, তা-ও বোঝা যাচ্ছে না।

Advertisement

সে বার মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে শ্রমিক আন্দোলনের জেরে ১৫ জুলাই থেকে বন্ধ হয়েছিল একের পর এক যন্ত্রচালিত তাঁত। সাতাশ দিনের মাথায় দাবি কিছুটা আদায়ের পর স্বাভাবিক হয়েছিল পরিস্থিতি। সেই কাজ বন্ধের রেশ কাটতে না কাটতেই করোনা ঠেকাতে এই লকডাউন। কম-বেশি প্রায় তিন হাজার কর্মহীন তাঁতশ্রমিক পরিবারের সামনে কোনও দিশা নেই।

চর স্বরূপগঞ্জের পাওয়ার লুম শ্রমিক কৃষ্ণবন্ধু দেবনাথের বাড়িতে ছোট-বড় মিলিয়ে জনাছয়েক সদস্য। তিনি জানান, “যে রবিবার জনতা কার্ফু হল, বলতে গেলে সে দিন থেকেই বন্ধ আমাদের কাজ। কিছু দিন চলেছে ঘরের সঞ্চয় দিয়ে। তার পর ধারদেনা শুরু হয়েছে। কিন্তু তিন সপ্তাহের মধ্যে সবে তো এক সপ্তাহ পার হয়েছে। এখনও দুই সপ্তাহ বাকি। বুঝতেই পারছি না, কী ভাবে সামাল দেব।” ছবিটা একই রকম চরমাঝদিয়ার অনাথ দেবনাথ, রমেন দেবনাথ কিংবা বিপ্রনগরের গৌতম দেবনাথের ঘরেও।

Advertisement

এক সময়ে নবদ্বীপের অর্থনীতির মূল ভিত্তি ছিল হস্তচালিত তাঁত। গঙ্গার পূর্ব পাড়ের স্বরূপগঞ্জ, চরমাজদিয়া, মাজদিয়া, চরব্রহ্মনগর, পানশিলা প্রভৃতি গ্রামগুলিতে আটের দশকেও অন্তত দশ হাজার হস্তচালিত তাঁত ছিল। হাজার হাজার পরিবারের প্রধান জীবিকা ছিল তাঁতবোনা। আটের দশকের পর থেকে ছবিটা আমূল বদলে যায়। হাতেবোনা তাঁতের শাড়ির চাহিদা তলানিতে ঠেকে। মুখ থুবড়ে পড়ে স্থানীয় অর্থনীতি। পরের তিন দশকে ক্রমশ ধ্বংস হয়ে যায় তাঁতশিল্প। তিনপুরুষের তাঁতি, তাঁত বোনা ছেড়ে বাধ্য হয়ে রিকশা চালানো, লটারির টিকিট বিক্রি কিংবা রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজ, দিনমজুরের কাজ শুরু করেন ওঁরা। পরিত্যক্ত তাঁতঘরে বাসা বাঁধে সাপখোপ। ছবিটা আবার বদলাতে শুরু করে দু’হাজার সাল নাগাদ। তাঁতের গোটা উৎপাদন প্রক্রিয়া যন্ত্রচালিত তাঁত বা পাওয়ার লুম নির্ভর হয়ে পড়ে। ফের কাপড়, গামছা, লুঙি বুনে রোজগারের মুখ দেখেন এলাকার তাঁতশ্রমিক ও তাঁতমালিকেরা। নবদ্বীপের গঙ্গা পার হয়ে পূর্ব পাড়ে স্বরূপগঞ্জ, চরমাজদিয়া-চরব্রহ্মনগর বা মাজদিয়ার আনাচকানাচ আবার যান্ত্রিক তাঁত চলার প্রবল শব্দে সকাল থেকে রাত মুখর হয়ে থাকত। গ্রামের কয়েক হাজার পরিবারের প্রধান জীবিকা ওই যান্ত্রিক তাঁত বা পাওয়ার লুমে কাপড় বোনা।

পাওয়ার লুমের শ্রমিকেরা জানাচ্ছেন, সাতাশ দিনের আন্দোলনে তাঁদের এক এক জনের গড় উপার্জন কিছু হলেও বেড়েছিল। যাঁরা শাড়ি বোনেন তাঁদের দৈনিক ৩০-৪০ টাকা, অন্য দিকে, যাঁরা গামছা বোনেন, তাঁদের ২০-২৫ টাকা গড় মজুরি বৃদ্ধি হয়েছিল। এই প্রসঙ্গে বাম তাঁতশ্রমিক সংগঠনের নবদ্বীপ পূর্ব এরিয়া কমিটির সম্পাদক হারাধন দেবনাথ বলেন, “সে বার মাসখানেকের একটানা লড়াইয়ের ফলে তাঁতশ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির দাবি মেনে নিয়েছিলেন মালিকপক্ষ। শাড়িতে বারো শতাংশ ও গামছায় এগারো শতাংশ মজুরি বৃদ্ধি করা হয়। অন্য দিকে দামি শাড়ি পিছু বারো টাকা করে মজুরি বাড়ানোর শর্তে বন্ধ কারখানা খুলেছিল। তবে সে সব শর্ত বহু ক্ষেত্রেই ঠিকমতো পালন করা হয়নি। আর তার ছ’মাসের মাথায় এই করোনা বিপর্যয় কল্পনার অতীত। কী ভাবে পরিস্থিতির মোকাবিলা করা হবে তা বুঝে উঠতে পারছি না।’’ তাঁর দাবি, শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারছেন সকলেরই হাতের পাঁচ ফুরিয়ে আসছে। যদিও লকডাউনের অনেকগুলো দিন কাটানো এখনও বাকি। ভাগীরথী পূর্ব পাড় হ্যান্ডলুম অ্যান্ড পাওয়ার লুম মালিক সমিতির তরফে মনীন্দ্র দেবনাথ জানান, ছোট-বড় মিলিয়ে চুয়ান্নটি লুম আছে ওই এলাকায়। সব মিলিয়ে সেখানে প্রায় তিন হাজার মানুষ কাজ করেন। অর্থাৎ, তিন হাজার পরিবার কার্যত উপার্জনহীন বর্তমানে। তিনি বলেন, “সোমবার লকডাউনের দিন থেকেই সব লুম বন্ধ। শুধু শ্রমিকেরা নন, উপার্জনহীন আমারও। প্রতিটি কারখানায় অসংখ্য শাড়ি, গামছা মেশিনে অর্ধসমাপ্ত অবস্থায় ঝুলছে। গোটা ব্যবসা প্রক্রিয়া থমকে। সরকারি সাহায্য শ্রমিকদের কাছে কিছু এলেও মালিকদের জন্য কিন্তু কিছুই আসে না। ফলে, আমরাও খুবই বেকায়দায়। এরই মধ্যে যে যেমন পারছেন, তাঁতশ্রমিকদের কম-বেশি অর্থ সাহায্য করছেন।”

কিন্তু ক’দিন এ ভাবে চলবে? লকডাউনের জেরে তাঁতশ্রমিকদের ঘরে ঘরে প্রশ্ন সেটাই।

অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement