ঝিটকিপোতায় স্কুলের সামনে খেলাধুলো। সব খুদেরই অবশ্য এই ‘স্বাধীনতা’ নেই। নিজস্ব চিত্র
অসময়ে স্কুলের লম্বা ছুটিটাই যত নষ্টের গোড়া। সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে রোহিতের। স্কুলের বন্ধু শান্তনু, অনুরাগ বা সুমনের সঙ্গে খেলা হচ্ছে না। তাই ভীষণ মনখারাপ সাত বছরের রোহিতের।
মনখারাপের যথেষ্ট কারণও আছে। স্কুলের সঙ্গে ফুটবল মাঠের স্যারও ছুটি দিয়েছেন। তাই পড়াশোনার পরে সারা দুপুর, বিকেল যেন কাটতেই চাইছে না। কোথাও নিয়ে যেতে বললেই মায়ের এক কথা— “বাইরে গেলে অসুখ করবে।” এ ভাবে বাড়িতে থাকতে কাঁহাতক ভাল লাগে!
নবদ্বীপের এক বেসরকারি স্কুলে কেজি টু-এ পড়ে রোহিত। মা রত্না সাহা বলেন, “ওদের তো বিরাট কিছু পড়া নেই। স্কুল থাকলে একটা সিস্টেমে চলে সবটা। পড়া, মাঠে যাওয়া, গান করা। সব কিছু নিয়ে সারা দিন কেটে যায়। রাতে তাড়াতাড়ি ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু এখন সে সব কিছু হচ্ছে বলে মুখ গোমড়া। কার্টুন কত দেখবে! কত গেমস খেলবে! বকুনিও খাচ্ছে মাঝে মাঝে।”
অয়ন্তিকার সমস্যা একটু অন্য রকম। কল্যাণীর ওরিয়েন্টাল পাবলিক স্কুলের পড়ুয়া অয়ন্তিকা রায়ের এ বার ক্লাস সেভেন। করোনাভাইরাসের সংক্রমণের ভয়ে স্কুল ছুটি। কিন্তু অন্য বারের ছুটির সঙ্গে এবারের ছুটির কোনও মিল নেই। স্কুলের ছুটি মানেই কোথাও না কোথাও বেরিয়ে পড়া। এবারের লম্বা ছুটিতে স্বাধীনতার নামগন্ধ নেই। উল্টে খালি শুনতে হচ্ছে— ‘‘না’’। টিভি দেখার অভ্যাস বা বইপড়ার নেশা নেই অয়ন্তিকার। কল্যাণীর মতো শহরের জীবনযাপন অনেকটাই কলকাতার ছাঁচে। সবই একটা নির্দিষ্ট ছন্দে চলে। নোভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণের ভয়ে প্রতি দিনের জীবনে ছন্দপতন ঘটেছে। স্কুল নেই, ফ্ল্যাট থেকে বের হওয়ার উপায় নেই। অয়ন্তিকার কথায়, “কিছুই তো করার নেই এখন। সারা দিন করবটা কী?”
অয়ন্তিকার মা সুস্মিতা রায় বলেন, “সমস্যা অন্য জায়গায়। আমাদের ছোটবেলার অবসর বলতে ছিল বইপড়া। ওদের বই পড়ার নেশা নেই। স্মার্টফোনই ওদের পৃথিবী। স্কুল, টিউশন থাকলে এক রকম। কিন্তু এখন পড়াও নেই। ফলে সারা ক্ষণ ফোন ঘাঁটছে। সব সময় যে গেমস খেলছে, এমন নয়। হয়তো অন্য কিছু দেখছে। যা হয়তো ওর দেখার কথা নয়। ঘরের কাজ সামলাতে গিয়ে সবসময় নজরদারি করাও সম্ভব নয়।’’
এ সব নিয়ে বললে বিরক্ত হচ্ছে অয়ন্তিকা। মায়ের উপরে রাগও হচ্ছে। এক অদ্ভুত পরিস্থিতিতে আটকা পড়েছে মা-মেয়ে দু’জনেই।
বাচ্চাদের এই আচমকা স্কুল-ছুটি আরও জটিল আকার ধারণ করেছে, যে সব পরিবারে বাবা-মা দু’জনেই কাজে বেরিয়ে যান, সেইখানে। মা স্কুলে শিক্ষকতা করেন আর বাবা কলকাতার নিত্যযাত্রী চাকুরে। বাড়িতে বয়স্ক ঠাকুমা আর পরিচারিকার কাছে থাকে ভার্গব সাহা। এত দিন সকাল আটটায় স্কুলবাসে তুলে দিতেন মা। ফিরতে ফিরতে বিকেল সাড়ে তিনটে বেজে যেত। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই কাজ থেকে ফিরতেন ভার্গবের মা।
কিন্তু স্কুলের লম্বা ছুটিতে সারা দুপুর একা একা ক্লান্ত-বিরক্ত হয়ে পড়ছে সপ্তম শ্রেণির ওই পড়ুয়া। টিভিতে কার্টুন, ডিসকভারি, ছোটা ভীম দেখে দেখে ক্লান্ত। ব্যাট হাতে বল পেটাতে বাইরে যেতে গেলেই ঠাকুমার গেল-গেল রব!
ভার্গবের সত্তর পার করা ঠাকুমা বলেন, “কী করি বলুন তো! এইটুকু বাড়ির মধ্যে চতুর্দিকে জিনিস। ওর মধ্যে ক্রিকেট খেললে ভেঙেচুরে যাবে। বাইরেও যাওয়া বন্ধ।”
করোনাভাইরাস সংক্রমণের আশঙ্কায় স্কুল-ছুটি এমন তিতকুটে হতে পারে, তা কে জানত!