এক সময়ের খাসতালুক নদিয়ায় প্রায় এক তৃতীয়াংশ আসনে প্রার্থী-ই দিতে পারল না কংগ্রেস! প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর সঙ্গে প্রাক্তন জেলা সভাপতি শঙ্কর সিংহের সাম্প্রতিক দ্বৈরথকেই যার অন্যতম কারণ বলে মনে করেন জেলার একাংশ কংগ্রেস কর্মী।
রাজ্যে পুরভোটের দামামা বেজেছে আগেই। অন্য জেলার সঙ্গেই নদিয়ায় আটটি পুর-এলাকায় ভোট আগামী এপ্রিলে। মনোনয়ন পর্বের শেষলগ্নে দেখা যাচ্ছে, নদিয়ার ১৫১টি আসনের মধ্যে মাত্র ৬৩টিতে প্রার্থী দিতে পেরেছে কংগ্রেস। গত পুরভোটে জিতে কংগ্রেস জেলায় শান্তিপুর এবং বীরনগরে বোর্ড গঠন করেছিল। তাৎপর্যপূর্ণ হল, এ বার বীরনগরের কোনও আসনেই প্রার্থী দেয়নি কংগ্রেস। একই অবস্থা তাহেরপুরে। শান্তিপুর পুর-এলাকার ২৪টি আসনের মাত্র সাতটিতে প্রার্থী দিয়েছে কংগ্রেস। গয়েশপুর, কল্যাণী, রানাঘাট, নবদ্বীপেও নামমাত্র আসনে প্রার্থী দিয়েছে তারা।
কেন এই হাল কংগ্রেসের মতো পুরনো দলের?
উত্তরে উঠে আসা একাধিক ব্যাখ্যার অন্যতম হল, জেলায় দলের সংগঠন একেবারে তলানিতে নেমে আসা। তা মেনেই বহু কর্মী-সমর্থক বলছেন, ‘নদিয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ জেলায় কংগ্রেস কার্যত অভিভাবকহীন!’ প্রদেশ সভাপতি অধীর চৌধুরীর সঙ্গে প্রাক্তন জেলা সভাপতি শঙ্কর সিংহের দ্বন্দ্ব সকলের জানা। গত লোকসভা নির্বাচনে সেই দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে আসে। তার প্রভাব পড়ছে সংগঠনে। পুরভোটে সব আসনে প্রার্থী না দিতে পারার জন্যে নিচু তলার কর্মী-সমর্থকেরা সমান ভাবে দায়ী করছেন যুযুধান দুই নেতাকেই। তাঁরা বলছেন, “এ বার একটা হেস্তনেস্ত না হলে কংগ্রেস সাইনবোর্ড হয়ে যাবে।”
শঙ্করবাবুর অনুগামীদের অভিযোগ, তাঁদের প্রার্থী হতে বলা তো দূরের কথা কোনও যোগাযোগই করেননি বর্তমান জেলা সভাপতি অসীম সাহা। হয়নি কোনও যৌথ মিছিল-মিটিংও। রানাঘাটের দু’বারের কাউন্সিলর তথা প্রদেশ কংগ্রেসের সদস্য দুলাল পাত্র বলেন, ‘‘পুরভোটের আগে একটি বারের জন্যও যোগাযোগ করেননি জেলা সভাপতি।” তবে একই ভাবে তাঁরাও যে দলের অন্য শিবিরের সঙ্গে যোগাযোগের নূন্যতম চেষ্টা করেননি তা-ও কবুল করছেন দুলালবাবু। শঙ্করবাবুর তৃণমূলে যোগ দেওয়া নিয়ে রাজনৈতিক মহলে জল্পনা তুঙ্গে। সে জন্যই কি এই অসহযোগিতা এবং পাল্টা হিসেবে শঙ্করবাবুর অনুগামীদের এড়িয়ে যাওয়া?
প্রদেশ সভাপতির ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত নদিয়া জেলা সভাপতি অবশ্য তেমনটা মানছেন না। অসীম সাহার দাবি, “আমরা চেয়েছিলাম সকলকে সঙ্গে নিয়ে পুরভোটে লড়তে। কিন্তু দলের একটা অংশ প্রথম থেকেই অসহযোগিতা করেছে। আমরা যাতে প্রার্থী না পাই তার জন্যও চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছে। তাতে ফল যা হওয়ার সেটাই হয়েছে।’’ অসীমবাবুর অভিযোগকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না শঙ্কর অনুগামীরা। তাঁরা এক ধাপ এগিয়ে জেলা সভাপতির যোগ্যতা, নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা নিয়েই প্রশ্ন তুলছেন। ‘‘গত পুরসভা ভোটে কৃষ্ণনগরে দাঁড়িয়ে যিনি নিজেই জিততে পারেননি, তিনি কী করে নেতৃত্ব দেবেন?’’ অকটপটেই বলছেন তাঁরা।
নদিয়া জেলা কংগ্রেস এখন এমনই কোন্দল, আকচাআকচি আর অবিশ্বাসের ছবি! তার প্রত্যক্ষ ফল রানাঘাটে ২০টি আসনের ৭টিতে, কল্যাণীতে ২১টি আসনের ৬টিতে, গয়েশপুরে ১৮টি আসনের ১১টিতে, শান্তিপুরে ২৪টি আসনের ৭টিতে এবং নবদ্বীপে ২৪টি আসনের ২০টিতে এবং হরিণঘাটায় ১৭টি আসনের ১২টিতে প্রার্থী দিতে পেরেছে কংগ্রেস। কোন্দলের ঊর্ধ্বে উঠে যেখানে প্রার্থী দেওয়া গেল, তার কতগুলি আসনে জয় আসবে তা নিয়েও সংশয়ে নিচুতলার কর্মীরা।
শান্তিপুর, বীরনগরে গত বার কংগ্রেস বোর্ড গঠন করেছিল। কংগ্রেসরই একটি সূত্রে খবর, সেই জয়ের নেপথ্যে ছিলেন অজয় দে ও পার্থ চট্টোপাধ্যায়রা। তাঁরা দল বদলে তৃণমূলে চলে যাওয়ায় কংগ্রেসের নীচু তলার কর্মীরা কার্যত দিশাহীন। সংগঠনও দুর্বল হয়েছে। তারই অকাট্য প্রমাণ পুরভোটে সব আসনে প্রার্থীটুকুও দিতে পারেনি কংগ্রেস। বীরনগরের এক কংগ্রেস কর্মীর কথায়, “কংগ্রেসের কিছু ভোট এখনও রয়েছে। একটি প্রার্থীও পাওয়া যাবে না, এমন পরিস্থিতি দলের এখনও তৈরি হয়নি। কিন্তু, নেতারা তো কোন্দলেই ব্যস্ত। দলের কথা ভাবার সময় তাঁদের কোথায়?”