নিরাপত্তা। হরিহরপাড়ায়। ছবি: স়ঞ্জীব প্রামাণিক
বিনা লড়াইয়ে জয়, বিরোধীদের দেখা নেই, এই পর্যন্ত ঠিক ছিল। কিন্তু তার পরেও পুলিশকে রুট মার্চ করতে হচ্ছে। তৃণমূলকে দলীয় সদস্যদের এনে রাখতে হচ্ছে কোনও আস্তানায়। প্রশ্নটা উঠছে এখানেই। পুলিশের একাংশ চাপা স্বরে বলছেন, ‘অর্থই অনর্থের মূল, বুঝলেন না!’ যত নষ্টের গোড়া ওই টাকা। বিরোধীরাও বলাবলি করছেন, ‘টাকার খেলা খেলতে গিয়েই এখন জমে গিয়েছে খেলা!’
কে প্রধান হবে আর, তার জন্য কে কাকে কত দেবে তা নিয়েই যত গণ্ডগোল। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী যেমন কোনও রাখঢাক না রেখেই বলছেন, ‘‘গ্রাম পঞ্চায়েতে সদস্য-ওয়াকশান চলছে, বুঝলেন!’’
সিপিএম ডোমকল এরিয়া কমিটি সম্পাদক মুস্তাফিজুর রহমান বলছেন, ‘‘অন্য কোনও মান নয়, টাকার অঙ্কে প্রধান নির্বাচন হচ্ছে। হচ্ছে সভাপতি নির্বাচন। এই টাকার দৌড়ে ছুটছে সকলে। যা হওয়ার সেটাই হচ্ছে।’’ তৃণমূল নেতা সৌমিক হোসেন পাল্টা ধরিয়ে দিচ্ছেন, ‘‘বিরোধীদের কাছে আর যাই হোক শৃঙ্খলার পাঠ নেব না। ওটা মানুষ ওদের শিখিয়ে দিয়েছে।’’
টাকার অঙ্কটা শুনে চমকাচ্ছেন অনেকে। কেউ আবার বলছেন ৫ বছরে টাকা তুলতে পারবে প্রধান হয়ে তাই ‘দাম’ দিতে প্রস্তুত। বিরোধীদের দাবি, এখনও পর্যন্ত একটি পঞ্চায়েতের প্রধান পদের জন্য ৪৮ লাখের সেরা ডাক উঠেছে। আর ২৫ থেকে ৩০ লাখ পঞ্চায়েতে প্রধানের জন্য প্রায় জল ভাত। পুলিশের আশঙ্কা এই অন্ধকার ছেড়ে ব্যাপারটা প্রকাশ্যে এলেই বিপদ। কেউ কাউকে এক ইঞ্চি জমি ছাড়বে না প্রধান পদের জন্য। বিশেষ করে জলঙ্গি ও ডোমকলে এই সমস্যাটা প্রকট হয়েছে। ফলে পুলিশকেও প্রায় দিন নামতে হচ্ছে মাঠে। চলছে রুটমার্চ। অন্য প্রান্তে, খড়গ্রামে উত্তেজনা কিছু কম নেই। আর তা দিয়েই বোর্ড গঠন হল সোমবার। খড়গ্রাম ব্লকের ছটি গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান গঠন হয়েছে। ওই ব্লকে বারোটি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে কীর্তিপুর, পদমকান্দি, ইন্দ্রাণী, ঝিল্লি জয়পুর ও সাদল, মোট ছয়টি গ্রাম পঞ্চায়েতে প্রধান নির্বাচন হয়। তার মধ্যে তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরে বড় ধরনের অশান্তির আশঙ্কার ইঙ্গিত ছিল সাদল গ্রাম পঞ্চায়েতে। দলীয় সূত্রে খবর ওই গ্রাম পঞ্চায়েতে মোট ১৮টি আসনের মধ্যে এগারো জন পঞ্চায়েত সদস্য সপ্তাহ খানেক আগেই এলাকা ছেড়েছেন। বাকি ছিল সাত সদস্য। ফলে ওই পঞ্চায়েতে প্রধান গঠন কেন্দ্র করে বড় ধরনের অশান্তির আশঙ্কা করে ওই দিন কান্দির সব পুলিশ কর্তাই হাজির ছিলেন সেখানে।
খড়গ্রাম বিডিও সৌরভ ধল্লও আকারে ইঙ্গিতে জানিয়েছেন, খড়গ্রাম অতি স্পর্শকাতর ব্লক। তাই দু’দফায় প্রধান নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিতে হয়। খড়গ্রাম ব্লকের তৃণমূলের সভাপতি মফিজুদ্দিন মণ্ডল লেন, ‘‘গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব বলে কিছু নেই। তবে প্রধান গঠন নিয়ে নিজেদের মধ্যে সদস্য তুলে নেওয়ার যে ঘটনা ঘটেছে সাদল পঞ্চায়েত এলাকায় সেটা না ঘটলেই ভাল হত।”
চোখ ফেরানো যাক, আহিরণের দিকে— দলে ভাঙান ঠেকাতে জয়ী সদস্যদের ঝাড়খন্ডে লুকিয়ে রেখে আহিরণে নিজের গড় বাঁচাল বিজেপি। এমনকি নির্দল হিসেবে দাঁড়িয়ে জয়ী এক তৃণমূল নেতাকে বিজেপি তাদের শিবিরে ভিড়িয়ে সোমবার সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রমাণ দিয়ে দখল করে নিল সুতি এক ব্লকের আহিরণ গ্রাম পঞ্চায়েতের বোর্ড । ১৭ সদস্যের এই পঞ্চায়েতে নির্বাচনের শুরু থেকেই বিজেপি ও তৃণমূলের মধ্যে উত্তেজনার পারদ চড়ছিল। মনোনয়ন প্রত্যাহারে শাসক দলের চাপ ঠেকাতে ভোটের আগেও সমস্ত দলীয় প্রার্থীকে পাশেই ঝাড়খন্ডের পাকুড়ে বিজেপির জেলা দফতরে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল বলে জানাচ্ছেন জেলা বিজেপির এক নেতা। সোমবার বোর্ড গঠন নিয়ে উত্তেজনার আশঙ্কায় জঙ্গিপুরের এসডিপিও, সুতির পুলিশ অফিসারেরা ছাড়াও সাগরদিঘির ওসিকেও নিয়ে আসা হয় আহিরণে।
বিজেপির উত্তর মুর্শিদাবাদের সভাপতি সুজিত দাস বলেন, ‘‘ ভোটে জেতার পর তৃণমূল দল ভাঙানোর চেষ্টা করতে থাকে। তাই গত এক মাস দলের সদস্যদের পাকুড়ে দলের জেলা কার্যালয়ে নিয়ে গিয়ে রাখা হয়।’’ তৃণমূলের লালগোলা ব্লক সভাপতি শুভরঞ্জন রায়ের কথাতেও সেই ইঙ্গিত, ‘‘ক্ষমতা যে লেঠেল বাহিনীর হাতে চলে গিয়েছে তার প্রমান মিলেছে আজ প্রধান গঠনের দু’টি ঘটনায়।’’
(তথ্য: সুজাউদ্দিন, বিমান হাজরা, কৌশিক সাহা এবং অনল আবেদিন)