স্বর্ণমন্দির: শান্তিপুরের বকুলতলায় শ্রীপুরম গোল্ডেন টেম্পলের অনুকরণে মণ্ডপ। ছবি: প্রণব দেবনাথ
ছিল উত্তেজক ওয়ান ডে, হয়ে গেল পাঁচ দিনের টেস্ট ক্রিকেট। আড়ে-বহরে দুর্গা পুজোকেও পিছনে ফেলে দিল নবদ্বীপের রাস। গত ২০ নভেম্বর পোড়ামাতলার মহিষমর্দিনী মাতার উদ্বোধনের মধ্যে দিয়ে যে রাসের সূচনা হয়েছে, আগামী ২৬ নভেম্বর কার্নিভালের মধ্যে দিয়ে তার সমাপ্তি ঘটবে। পুরো এক সপ্তাহের উৎসব প্যাকেজ।
একই সঙ্গে নবদ্বীপের রাসের হালের ‘ট্রেন্ড’ প্রতিমার উদ্বোধনে আবরণ উন্মোচন বা ফিতে-কাটা। তাতে হাজির থাকেন লেখক থেকে গায়ক, খেলোয়াড় থেকে রাজনৈতিক নেতৃত্ব। এ বারের রাসে নবদ্বীপে উদ্বোধক হিসাবে দেখা গিয়েছে গায়ক সিধু, ফুটবলার রহিম নবী, ‘পাণ্ডবগোয়েন্দা’ লেখক ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়, সুরকার জয় সরকার, মন্ত্রী স্বপ্ন দেবনাথ-সহ প্রমুখকে।
তবে উদ্বোধন করা প্রতিমার সংখ্যা গুনে শেষ করতে পারা যাচ্ছে না, জানালেন বিধায়ক পুণ্ডরীকাক্ষ সাহা এবং পুরপ্রধান বিমানকৃষ্ণ সাহা। মঙ্গল, বুধ এবং বৃহস্পতি— এই তিন দিন সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত উদ্বোধনে ছুটে বেরিয়েছেন ওই দু’জন। উদ্বোধনের বিভিন্ন জায়গায় মঞ্চ বেঁধে হয়েছে সাংস্কৃতিক এবং প্রতিযোগিতা মূলক অনুষ্ঠান।
প্রায় তিনশো বছর ধরে বদলাতে বদলাতে নবদ্বীপের রাস এখন এমনই আকার ধারণ করেছে। শহরের অশীতিপর ‘রাসুরেরা’ বলেন, তাঁদের ছোট বেলায় বেশির ভাগ প্রতিমা শেষ হত রাসের দিন সকালে। সারা রাত কাজ করে ভোর বেলা ভারা খুলে প্রতিমা প্রণাম করে চলে যেতেন পালমশাই। তার পর পাড়ার মহিলারা পুজোর জায়গা পরিষ্কার করে, গোবর নিকিয়ে পুজোর আয়োজন করতেন। সব মিটতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে যেত। এর পর রাতে চটের প্যান্ডেলের নিচে টিমটিমে আলোয় প্রতিমার সামনে ঢোল-সানাইয়ের তালে নাচ। মাত্র পঞ্চাশ বছর আগেও এই ছিল নবদ্বীপের রাসের ছবি।
তবে তিনশো বছর ধরে কালের নিয়মে উৎসবের গা থেকে খসে পড়েছে প্রাচীনত্ব। সময়ের ছোঁয়াচ লেগেছে রাসে। যদিও উদ্বোধনের এই হিড়িক নিতান্তই গত কয়েক বছরের।
বর্তমানে নবদ্বীপের রাস উৎসবের নান্দীমুখ হয়ে উঠছে জমকালো এই উদ্বোধন। নদিয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় পটপূর্ণিমায় নবদ্বীপের রাস উৎসবের শুরু। তার পর গঙ্গা দিয়ে গড়িয়েছে অনেক জল। নবদ্বীপের অন্যতম প্রধান উৎসবকে ঘিরে উদ্যোক্তাদের নতুন নতুন ভাবনাচিন্তা রাসকে সময়োপযোগী করে তুলছে। তিনশো বছরের দিকে পা বাড়ানো রাস আগের চেয়ে অনেকটাই বদলেছে। মূল উৎসবের দিন তিনেক আগে থেকেই শুরু হয়ে যাচ্ছে এই উদ্বোধন পর্ব। সকাল থেকে মধ্যরাত, শহরের পূর্ব থেকে পশ্চিম, উত্তর থেকে দক্ষিণ জুড়ে কেবলই প্রতিমা উদ্বোধন।
সুউচ্চ প্রতিমার বদলে থিমের পুজো, দিনের দিন প্রতিমা নির্মাণ শেষ করে পুজোর বদলে পাঁচ দিনের রাস, এক দিনের আড়ং থেকে কার্নিভ্যাল— সব মিলিয়ে ফের নতুন এক বাঁকের মুখে নবদ্বীপের বর্তমান রাস উৎসব।