যুযুধান দুই প্রার্থী সম্মানী মণ্ডল (বাঁ দিকে) ও সোহাগী মণ্ডল। — নিজস্ব চিত্র।
সিপিএম বনাম কংগ্রেস, তৃণমূল, বিজেপি এবং এসইউসি-র মহাজোট!
সিপিএমের মোকাবিলায় জঙ্গিপুরের ৮ নম্বর ওয়ার্ডে মহাজোট গড়ল যুযুধান চার-চারটি রাজনৈতিক দল। সিপিএম প্রার্থী সম্মানী মণ্ডলের বিরুদ্ধে নির্দল প্রার্থী সোহাগী মণ্ডলকে দাঁড় করিয়ে জোট চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে মহাজোট। প্রায় পঁচিশ বছর বামেদের দখলে রয়েছে এই ঝাকসুর ধনপতনগর এলাকা।
আপাত নিরীহ মাধ্যমিক অনুত্তীর্ণ দুই গৃহবধূর লড়াইয়ে এলাকা সরগরম। মুর্শিদাবাদে ৬টি পুরসভায় ১০৭টি ওয়ার্ডে নির্বাচন হচ্ছে। তার মধ্যে একমাত্র ব্যতিক্রম জঙ্গিপুরের এই ওয়া়র্ডটি। রাজনীতিতে কংগ্রেস-তৃণমূল, বিজেপি কিংবা এসইউসি-- একের সঙ্গে অন্যের যখন তুমুল বিরোধিতার সম্পর্ক সেখানে জোট দানা বাঁধল কী করে? কোন বাধ্যবাধকতা থেকেই বা এই মহামিলন?
স্থানীয়দের একটি বড় অংশ সম্বস্বরে জানালেন, এলাকার উন্নয়নের স্বার্থেই এককাট্টা হয়ে এমন সিদ্ধান্ত। স্থানীয় বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত পোস্ট মাস্টার তুলসীচরণ মণ্ডল বলেন, ‘‘গত ৩০ বছর বামফ্রন্ট জঙ্গিপুর পুরসভায় ক্ষমতায় রয়েছে। ধনপতনগর থেকে সিপিএমের প্রার্থীরা নির্বাচিত হয়ে আসছেন টানা ২৫ বছর। তবু এলাকার অনুন্নয়নের নমুনা পদে পদে। পরিস্থিতি দেখে, গ্রামের সব বাম বিরোধী সমর্থক এক সঙ্গে বসে জোট গড়ে একজন নির্দল প্রার্থীকে দাঁড় করানো হয়েছে।’’
মূল শহর থেকে কিছুটা দূরে এই ৮ নম্বর ওয়ার্ডে মূলত কৃষিজীবীর বাস। জঙ্গিপুর ও রঘুনাথগঞ্জ শহরের বাজারে সব্জির সিংহভাগই সরবরাহ হয় এই এলাকা থেকে। এলাকার ধনপতনগর পল্লীতেই জন্ম আলকাপের স্রষ্টা ঝাঁকসু ওরফে ধনঞ্জয় মণ্ডলের। এহেন জনপদেই এই নজিরবিহীন লড়াই হতে চলেছে। পল্লীবাসীর অভিযোগ, গত দেড়শো বছরে শহর যে ভাবে এগিয়েছে শহরের অংশীদার হয়েও ধনপতনগর ও রাধানগর সে ভাবে এগোতে পারেনি। সেই ক্ষোভ থেকেই মহাজোটের প্রার্থী করা হয়েছে সোহাগীকে।
সাধারণ মানুষের একটা বড় অংশ কী চাইছেন, তা আঁচ করে রাজনৈতিক দলগুলিও অন্য পথে হাঁটেনি। জঙ্গিপুর শহর কংগ্রেসের সভাপতি সঞ্জীব মণ্ডল বলেন, ‘‘আমরা দলীয় এক প্রার্থীকে দাঁড় করিয়েছিলাম। কিন্তু গোটা গ্রাম যেহেতু বাম বিরোধী জোট চাইছে, তাই প্রার্থী তুলে নিয়েছি।’’ তাই বলে বিজেপি, তৃণমূলের সঙ্গে এক মঞ্চে? সঞ্জীববাবুর ব্যাখ্যা, ‘‘এটা জোট নয়। আমরা মানুষের মঞ্চে সামিল হয়েছি। সে মঞ্চে সামিল হয়েছে অন্য দলও।’’
তৃণমূলের নির্বাচনী কমিটির সদস্য তথা দলের শিক্ষা সেলের চেয়ারম্যান শেখ ফুরকানও বলছেন, ‘‘গ্রামের মানুষের দাবি মেনেই এই সমর্থন। এর রাজনৈতিক অর্থ খোঁজা ঠিক নয়। এই ওয়ার্ডে অনুন্নয়নের সঙ্গেই সকলের লড়াই। তাতে তৃণমূলও সামিল হয়েছে।’’ বিজেপির জেলা সহ সভাপতি কমল সাহা বলেন, ‘‘ওই পিছিয়ে পড়া এলাকার বিজেপি কর্মীরা চেয়েছেন সিপিএমের বিরুদ্ধে এক জোট হয়ে লড়তে। সে জন্যই এই সমর্থন।’’ এলাকায় এসইউসি-র শতাধিক সমর্থক রয়েছেন। প্রতিবার তারাও প্রার্থী দেন। এ বারে মহাজোটে সামিল তাঁরাও।
বস্তুত ধনপতনগর, রাধানগর এবং এনায়েতনগর-- এই তিন এলাকা নিয়েই গড়ে উঠেছে ৮ নম্বর ওয়ার্ড। ২০১০ সালের নির্বাচনে ৩,০৫৪ জন ভোটার ছিল এই ওয়ার্ডে। এ বার ওয়ার্ড ভেঙে তৈরি হয়েছে ২১ নম্বর ওয়ার্ড। ৮ নম্বর ওয়ার্ডে এ বারে ভোটার ২,২২৯। সম্মানী ও সোহাগীর লড়াইয়ে প্রথমেই মহাজোট ঠোক্কর খেয়েছেন নাম বিভ্রাটে। ইতিমধ্যেই এলাকা বাহারি দেওয়াল লিখনে ভরিয়ে দিয়েছে বামেরা। তবে এখনও মহাজোটের প্রার্থীর হয়ে দেওয়াল লিখন নজরে পড়েনি এলাকায়। কেন? মহাজোটের বক্তব্য, নির্দলের প্রতীক পেতে দেরি হয়েছে। তাই এই বিলম্ব!
নির্বাচন কমিশনের তালিকায় সোহাগীর নামও সম্মানী মণ্ডল বলে ছাপানো হয়। সোহাগীর সংযোজন, ‘‘বহু আগে একই ভাবে ভোটার কার্ডেও আমার নাম সম্মানী মণ্ডল বলে লেখা হয়েছিল। পরে সংশোধন করে সোহাগী করা হয়।’’ তারপরেও পিছু ছাড়েনি নাম বিভ্রান্তি। সোমবার সকালে নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে এই বিভ্রান্তি দেখে প্রতিবাদ করি। রাজ্য নির্বাচন কমিশনার সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায় বলেন, ‘‘এই নাম বিভ্রাটের দায় আমাদের নয়। সবটাই করেছে জেলা নির্বাচনী দফতর। আমাদের কাছে সংশ্লিষ্ট প্রার্থীর কোনও নথি নেই। স্থানীয় নির্বাচনী দফতরে যোগাযোগ করতে হবে।’’ এরপরই অভিযোগ যায় জঙ্গিপুরের পুর-নির্বাচনী দফতরে। তখনই তড়িঘড়ি সম্মানী নাম মুছে সোহাগী করা হয়।
বিরোধী প্রার্থী সোহাগীর মতো সিপিএম প্রার্থী সম্মানী মণ্ডল নিজে কখনও রাজনীতি করেননি। তবে তাঁর পরিবারে প্রায় সকলেই সিপিএমের সঙ্গে যুক্ত। স্বামী রাম মণ্ডল বলছেন, ‘‘জোট, মহাজোট যাই হোক, ভোট দেবেন এলাকার মানুষ। তাঁদের সঙ্গে সারা বছর মিশে থেকে কাজ করি আমরা। জয় নিয়ে কোনও দুশ্চিন্তাই নেই।’’
গত বার এই ওয়ার্ড থেকে সিপিএম ৪২৮ ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছিল। এসইউসি প্রার্থী পেয়েছিলেন ১২৭ ভোট। এ বারে মহাজোটের ডাক সেই বামদুর্গ ভাঙতে পারে কি না, দেখার সেটাই।