ছোটদের লেখা একটি চিঠি। নিজস্ব চিত্র।
জলঙ্গি নদীকে দখল-মুক্ত করে, তার স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরিয়ে আনাই এখন মূল উদ্দেশ্য। তাই জেলার বিভিন্ন প্রান্তের প্রায় ১০ হাজার পড়ুয়াকে দিয়ে জেলাশাসকের কাছে পোস্টকার্ডে চিঠি দেওয়ার কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। এর নাম দেওয়া হয়েছে— ‘হ্যালো কলকাতা’।
প্রায় দশ হাজার পড়ুয়া পোস্টকার্ডে জেলাশাসকের কাছে চিঠি পৌঁছে দেওয়ার কর্মসূচি নিয়েছে। অনেকেই এর মধ্যে চিঠি দেওয়া শুরু করেছে। জেলাশাসক শশাঙ্ক শেঠী বলেন, “জলঙ্গি নদীকে নিয়ে অনেক সমস্যা আছে। আমি সেই সব সমস্যার সমাধানের জন্য মহকুমা শাসকদের একটি কমিটি গড়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করতে বলে দিয়েছি।”
এলাকার নদীপ্রেমীদের দাবি, যে ভাবে নদীখাত দখল করে ক্রমশ সেতু, রাস্তা তৈরি হয়ে চলেছে, তাতে খুব শীঘ্রই জলঙ্গি নদী পরিণতি হতে চলেছে অঞ্জনার মতোই। এমনটাই আশঙ্কা নদী বিশেষজ্ঞ থেকে স্থানীয়দের। দীর্ঘ দিন ধরে নদী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত স্থানীয়দের আরও অভিযোগ, সম্পূর্ণ পরিকল্পিত ভাবে একটু-একটিু করে জলঙ্গি নদীর স্বাভাবিক প্রবাহকে বন্ধ করে দেওয়া চলছে।
তাঁদের দাবি, নদীর উৎসমুখ অনেক দিন আগেই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। উৎসমুখ থেকে প্রায় ৪৮ কিলোমিটার নদী পুরোপুরি প্রবাহহীন হয়ে পড়েছে। এর পাশাপাশি, বাকি অংশেও চলছে নদী বুজিয়ে ফেলার কাজ। এই পরিস্থিতিতে বিভিন্ন পরিবেশপ্রেমী সংগঠন এর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেছে।
নদিয়া জেলার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নদী জলঙ্গি। নবদ্বীপের স্বরূপগঞ্জ থেকে করিমপুর এলাকায় মুর্শিদাবাদ সংলগ্ন উৎসমুখ পর্যন্ত এই নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ২২০ কিলোমিটার। কৃষ্ণনগর ও তেহট্ট মহকুমার প্রায় ন’টি ব্লকের উপর দিয়ে বয়ে গিয়েছে এই নদী। এই বিস্তীর্ণ এলাকায় সেচের পাশাপাশি জল পরিবহণের ক্ষেত্রেও নদীটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পাশাপাশি, নদীর দুই পাড়ের শয়ে শয়ে মৎস্যজীবী পরিবারের জীবনজীবিকা পুরোপুরি এই নদীর
উপরেই নির্ভরশীল।
ফলে, শুধু পরিবেশগত ভাবেই নয়, এই বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থাও এই নদীর উপরে নির্ভরশীল। কিন্তু দিনের পর দিন নদীটির উপরে ধারাবাহিক ভাবে নানা অত্যাচার চলছে বলে অভিযোগ। নদীর বুক থেকে হারিয়ে যাচ্ছে মাছ। সঙ্কটের মধ্যে পড়ছেন স্থানীয় মৎস্যজীবীরা। বর্তমানে নদী ক্রমশ সঙ্কীর্ণ হয়ে পড়েছে। নদীর নব্যতা কমে যাচ্ছে। নানা জায়গায় দেখা দিচ্ছে ভাঙন। এই পরিস্থিতিতে সমাজের সব স্তর থেকেই জলঙ্গি নদীর সংস্কারের দাবি উঠেছে। সব ধরনের বাঁধা মুক্ত করে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরিয়ে আনার দাবি ক্রমশ জোরালো হয়েছে।
সেই দাবির কারণেই চলতি বছরে জলঙ্গি নদীর উপর থেকে মাছ ধরার জন্য বাঁশ ও জাল দিয়ে তৈরি বাঁধ বা বাঁধাল-মুক্ত করতে বাধ্য হয়েছে প্রশাসন। এ বার নদী আন্দোলনকারীদের দাবি, নদীর গহ্বর থেকে তুলে দিতে হবে
অন্য বাঁধা।
তাঁদের দাবি, চাপড়া থেকে একেবারে করিমপুর ২ ব্লক পর্যন্ত মানুষের পারাপারের সুবিধার জন্য নদীর বুকে বেশ কয়েকটি অস্থায়ী বাঁশের সেতু তৈরি করা হয়েছে। এমনকি, কোথাও কোথাও নদী ভরাট করে রাস্তা পর্যন্ত তৈরি করা হয়েছে বলে অভিযোগ। সেই তালিকায় যেমন আছে চাপড়া ব্লকের হাঁটরার ঈশ্বরীপাটনী ঘাট, তেমনই রয়েছে সুখসাগর ঘাট। রয়েছে পুখুরিয়া ঘাট, বাঙালঝি-কালীনগর ঘাট, সোনাতলা-পীতম্বরপুর ঘাট, পাত্রদহ-গোখুরাপোতা ঘাট, হাঁটরা-তেঘরি ঘাট, পেটোঙাভা-নতুনগ্রাম ঘাট। বীরপুরে ঘাটগুলিতে নৌকা চলাচলের পরিবর্তে সেখানে বাঁশের সাঁকো তৈরি করা হয়েছে। ইজারাদারাই এগুলি তৈরি করেছেন বলে অভিযোগ। পরিবেশ প্রেমীদের অভিযোগ, নদীতে নৌকা না চালিয়ে এই সাঁকো ব্যববার করা হচ্ছে। তার বদলে টাকা নেন ইজারাদারেরা। আর এই সাঁকো তৈরি করতে গিয়ে নদীগর্ভের অনেকটাই বুজিয়ে দেওয়ায় নদী তার স্বাভাবিক গতি হারিয়েছে।
তেহট্টের পাশাপাশি করিমপুর এলাকাতেও একই অবস্থা। করিমপুর-বক্সিপুর ঘাট থেকে শুরু করে রাধানগর ব্রিজের দু’পাশে নদীর একই বেহাল দশা বলে অভিযোগ। পাশাপাশি, কালীবাবার ঘাট থেকে দোগাছি-কালীতলার ঘাটেরও একই অবস্থা বলে স্থানীয়দের দাবি। আবার, করিমপুর ২ ব্লকের সাহেবপাড়া-মধুরকুল ঘাটে নদীর উপরে মাটি, ইট, ঘাস ফেলে গাড়ি যাতায়াতের জন্য রাস্তা তৈরি করে ফেলা হয়েছে।
‘সেভ জলঙ্গি’র যুগ্ম সম্পাদক শঙ্খশুভ চক্রবর্তী বলছেন, “নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছে। নদীপথে যাতায়াত তো দূরের কথা, নদীটিকে আর কত দিন বাঁচিয়ে রাখা যাবে, সেটাই এখন লাখ টাকার প্রশ্ন।”