ক্রেতার অপেক্ষায় কাশ্মীরি শাল ব্যবসায়ী। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য।
সুনসান দোকানে গদিতে বসে এক মনে মোবাইলে খুটখুট করছিলেন বছর চল্লিশের বশির। সকাল থেকেই দোকানে খদ্দের নেই।
কৃষ্ণনগরের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র পাত্রবাজারের সামনে তাঁর পনেরো বছরের দোকান। প্রতি বার শীতের শুরুতেই বারামুলার উরি থেকে নেমে আসেন ওঁরা। কিন্তু, এমন নভেম্বর কখনও দেখেননি।
অশান্ত কাশ্মীর থেকে বেরিয়ে এসে বশিরেরা ভেবেছিলেন, কার্ফু-বন্ধের দম বন্ধ করা অবস্থাটা পেরিয়ে এলাম বুঝি। টানা পাঁচ মাসের অস্থিরতায় যে বিপুল লোকসান আর দুর্দশা হয়েছে, তা-ও কিছুটা পুষিয়ে নেওয়া যাবে। কিন্তু তা হল কই?
গত ৮ জুলাই হিজবুল মুজাহিদিন কম্যান্ডার বুরহান মুজফ্ফর ওয়ানি ভারতীয় সেনার হাতে নিহত হওয়ার পরেই টানা হরতালের রাস্তায় চলে গিয়েছিল কাশ্মীর উপত্যকা। দোকান-বাজার-স্কুল বন্ধ। রাস্তায়-রাস্তায় শুধু প্রতিবাদ মিছিল, পাথর ছোড়া আর সেনাদের পাল্টা গুলি, কাঁদানে গ্যাস, পেলেট। জনজীবন স্তব্ধ।
গোটা পর্বটায় শ্রীনগরের বাড়িতে বসে মধ্য পঞ্চাশের মহম্মদ আমিন ভেবে গিয়েছেন, পয়লা নভেম্বর কবে আসবে। তিন পুরুষ ধরে তাঁরা এই দিনটায় বহরমপুরে আসেন। থাকেন সাড়ে চার মাস। শাল-স্টোল বিক্রির শেষে ১৫ মার্চ শ্রীনগরের উদ্দেশে রওনা দেন। এ বারও সময় মতোই পৌঁছে গিয়েছিলেন।
কিন্তু এক সন্ধেয় ওলোটপালট হয়ে গেল সব। বুরহানের মৃত্যুতে কাশ্মীর স্তব্ধ হয়ে যাওয়ার ঠিক পাঁচ মাস পরে— ৮ নভেম্বর, প্রধানমন্ত্রী নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করার সঙ্গে-সঙ্গে। আমিন বলেন, ‘‘কাশ্মীর স্তব্ধ হয়ে যাওয়ার পরে মাঝে-মাঝেই মনে হয়েছে, আমাদের দ্বিতীয় বাস্তুভিটে বাংলার কথা, লেকিন সব্ গড়বড় হো গিয়া বাই!’’
প্রতি বারই বহরমপুরের গ্রান্ট হল লাগোয়া একটি হোটেলে থাকেন আমিন ও তাঁর সঙ্গীরা। সেখানেই দোকান দেন। এ বারও দিয়েছেন। কিন্তু সে দোকান মাছি তাড়াচ্ছে। বাড়ি-বাড়ি ঘুরেও বিক্রি নেই। কারও হাতে নগদ টাকাই নেই, এখন শাল কিনবে কে? আমিন-বশিরদের মতো শালওয়ালারা অবশ্য চেনা বাড়িতে ধারেই মাল দেন। মার্চে দেশে ফেরার আগে বকেয়া টাকা চেয়ে আনেন। আমিন বলেন, ‘‘এখন কেউ ধারেও শাল নিচ্ছে না। দেখতেই চাইছেন না। বড়া কমবখত্ সিজন হ্যা, কত শালের যে ভাঁজই ভাঙেনি।’’ হাসি হারিয়ে গিয়েছে মহম্মদ আলিরও।
কপালে চিন্তার ভাঁজ। বলেন, ‘‘প্রতি বছর আসছি। এর মধ্যে কত কিছু ঘটে গিয়েছে। কিন্তু ব্যবসায় এত মন্দা কখনও দেখিনি।” কুরচিপোতায় ভাড়াবাড়িতে ডাঁই করা পোশাকের মধ্যে বসে আলির ছেলে বরকত ডর বলেন, “বিক্রি প্রায় তিরিশ শতাংশে নেমে এসেছে। খরচ তুলতে পারব কি না, সেটাই বুঝতে পারছি না।”
কাশ্মীরে এপ্রিল থেকে শুরু হয় পর্যটনের মরসুম। এ বার জুলাইয়ের আগে ব্যবসাপাতি ভালই চলছিল। জুলাইয়ে পৌঁছেই সব এলোমেলো হয়ে গেল। শীতের মরসুমের ব্যবসার জন্য প্রস্তুতি নিতেও প্রচুর কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। শাল ঘরে-ঘরে তৈরি হয়। কিন্তু তার জন্য কাঁচা মাল মিলবে কোথায়? উল আর চামড়ার কারখানা বন্ধ থেকেছে এত দিন।
এই হালে যখন পরিস্থিতি কিছুটা শুধরোতে শুরু করেছে, তার আগেই উপত্যকা ছেড়ে বেরিয়ে এসেছেন আমিন-বরকত-বশিরেরা। বশিরের ভাই জহির আর কাকা মরসিলিনও এসেছেন তাঁর সঙ্গে।
বরকতের এক ছেলে, এক মেয়ে। ছেলে এনায়েত একাদশ শ্রেণি আর মেয়ে এরিফত দ্বাদশ শ্রেণি। নানা রঙের শাল দেখাতে দেখাতে বলতে থাকেন বরকত, “খুব ক্ষতি হয়ে গেল জানেন। ব্যবসা বাণিজ্য তো একেবারেই হল না। তার উপরে ছেলেমেয়েগুলোর পড়াশোনার একই অবস্থা। জুনের পর আর স্কুল হয়নি।” সুযোগ পেলেই ফোন করেন বাড়িতে। বোঝার চেষ্টা করেন পরিস্থিতি। হতাশ জহির, মারশিলিনরা সন্ধ্যায় ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফেরেন। সাইকেলের কেরিয়ারে বছর বোঝাটা তবু হাল্কা হয় না!