বুনো রামনাথ।
আরুণেয় শ্বেতকেতুকে তাঁর পিতা বলেছিলেন, ‘‘তোমাকে ছেড়ে থাকতে আমার কষ্ট হবে। কিন্তু তুমি শিক্ষকের কাছে যাও। কেননা, আমরা এখানে যাঁরা রয়েছি, তাঁরা কেবলই জন্মসূত্রে ব্রাহ্মণ। আমরা শিক্ষা গ্রহণ করিনি। কিন্তু শিক্ষিত হওয়া প্রয়োজন।’’
ছান্দোগ্য উপনিষদে এই বৃত্তান্তের সঙ্গেই লেখা রয়েছে, শিক্ষকের কাছ থেকে যে জ্ঞান লাভ করা যায়, তা খুব নিশ্চিত ভাবেই লক্ষ্যে পৌঁছে দেয়।
সেই শিক্ষক কিন্তু শুধু শিক্ষিত ছাত্রই তৈরি করেন না। তাঁর গুরুকুল থেকে যে ছাত্রেরা বেরিয়ে সমাজে পা রাখেন, তাঁরা সামাজিক আচার সম্পর্কেও সমান অভিহিত থাকেন। তাঁরা হয়ে ওঠেন মেরুদণ্ড সম্পন্ন সুনাগরিক। তাঁরা যুক্তিবাদী। তাঁরা রাজারও ভুল ধরতে পারেন। যেমন শ্বেতকেতু আক্রমণ করেছিলেন জনককে। রাজাও তাঁদের সমান ভাবেই সম্মান করতেন। সেই সমাজই ছিল কাম্য।
প্রাচীন ভারতের এই প্রথা দীর্ঘ দিন পর্যন্ত ধরে রেখেছিলেন তক্ষশীলা, কাশী, মথুরা, মিথিলা, নবদ্বীপের পণ্ডিতেরা। এই সব শহরই বিশ্ববিদ্যালয় নগরী হিসেবে খ্যাতিও লাভ করে। নবদ্বীপে সেই খ্যাতির অঙ্গ ছিলেন রামনাথ তর্কসিদ্ধান্ত। যাঁর কাছে নানা জায়গা থেকে ছাত্রেরা পড়তে আসতেন। তিনি পাঠদানের মধ্যে দিয়েই নতুন পাঠ তৈরি করতেন। এই ছিল এক গৌরবের কথা। সমাজের জন্য সুনাগরিক তৈরি করে দেওয়া।
সেই গৌরবের অঙ্গ ছিলেন তাঁর স্ত্রী-ও। সেই গৌরবের আকারটি বোঝাতেই তৈরি হয়েছে কয়েকটি কাহিনিও। যেমন, একবার নবদ্বীপের গঙ্গায় স্নান করতে এসেছেন নদিয়ার রাজমহিষী। তাঁর স্নানের সময় অন্যদের যাওয়া আসা বন্ধ। দাসী পরিবৃত হয়ে ঘাট জুড়ে নিশ্চিন্তে স্নান করছেন রানি। এমন সময় দ্রুত পায়ে নদী থেকে উঠে এলেন এক ব্রাহ্মণ রমণী। তাঁর ভিজে কাপড় থেকে জলের ছিটে লাগল রানির গায়ে। কিন্তু তরতরিয়ে ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে থাকা রমণী সে দিকে ভ্রূক্ষেপও নেই।
জীর্ণ ‘ঠেটি’ পড়া বামনীর এমন স্পর্ধা দেখে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন রানি। ছিন্ন বস্ত্র, অলংকার দূরে থাক হাতে শাঁখা-পলা পর্যন্ত নেই। এয়োতির চিহ্ন বলতে কব্জিতে জড়ানো লাল রঙের সুতো। ঘা লাগল রাজকীয় অহঙ্কারে। কঠিন মুখে মন্তব্য ছুঁড়ে দিলেন, “ভারি তো দু’গাছা লাল সুতো। তার আবার এতো দেমাক। ওই সুতো ছিঁড়তে কত ক্ষণ?”
কথা শেষ হতেই ঘুরে দাঁড়ালেন রমণী। রানির চোখে চোখ রেখে দৃঢ় স্বরে বললেন, “এই লাল সুতো যে দিন ছিঁড়ে যাবে, সে দিন নবদ্বীপ অন্ধকার হয়ে যাবে।”
এ কথা মানাতো রামনাথের স্ত্রীর মুখেই।
শিক্ষার অহঙ্কারে রামনাথ দারিদ্রকেও বরণ করে নিয়েছিলেন। ‘বুনো রামনাথ’ নামেই সমধিক পরিচিত নব্যন্যায়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত সম্পর্কে ‘বাঙালির সারস্বত চর্চা’ গ্রন্থের প্রথম ভাগে বঙ্গে নব্যন্যায়চর্চা প্রসঙ্গে দীনেশচন্দ্র ভট্টাচার্য মন্তব্য করেছেন, “তাঁহার বিষয়নিঃস্পৃহতা শাস্ত্রব্যবসায়ীর আদর্শ লোকসমাজে উদ্বুদ্ধ করিয়া ধন্য হইয়া ছিল।” নবদ্বীপের পণ্ডিতমণ্ডলী তখন নব্যন্যায়ের দুনিয়া শাসন করছেন। সেই সময়ে এই দরিদ্র দম্পতির জীবনযাপনকে নিয়ে প্রাচ্যের অক্সফোর্ডে ভেসে বেড়ায় নানা কাহিনি। দেশবিদেশের ছাত্রদের মুখে মুখে সেসব পল্লবিত হয়ে ছড়িয়ে পরে দেশ থেকে দেশান্তরে।
সে কালেও বুনো রামনাথের মতো দরিদ্র পণ্ডিত খুব কমই ছিলেন। বর্ধিষ্ণু জনপদ নবদ্বীপের এক প্রান্তে বনাকীর্ণ এলাকায় জরাজীর্ণ কুটিরে বাস করতেন বলে তিনি বুনো রামনাথ নামে পরিচিতি লাভ করেন। সেই সময়ে নবদ্বীপে স্মৃতির পণ্ডিত আরও একজন রামনাথ ছিলেন। নবদ্বীপের গ্রামীণ এলাকায় বাস করতেন বলে তিনি গেঁয়ো রামনাথ নামে পরিচিত ছিলেন।
বুনো রামনাথ সম্পর্কে আরও একটি কাহিনি প্রচলিত। তখন তিনি খ্যাতির মধ্য গগনে। সারাক্ষন ডুবে আছেন নব্যন্যায়ের জটিল প্রশ্নে। একদিন সকালে টোলে যাচ্ছেন অন্যমনস্ক রামনাথ। ব্রাহ্মণী জানতে চাইলেন আজ তো ঘরে কিছুই নেই। কি রান্না হবে। চিন্তামগ্ন পণ্ডিতমশাইয়ের কানে সে প্রশ্ন ঢুকলে তো। উল্টে নির্বিকার ভাবে উঠোনের তেঁতুলগাছটা দেখতে দেখতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন।
এরপর যথারীতি দুপুরে বাড়ি ফিরলেন রামনাথ। ভারতবিখ্যাত নৈয়ায়িকের দ্বিপ্রাহরিক ভোজনে সেদিন ব্রাহ্মণী পরিবেশন করলেন এক আশ্চর্য পদ। মোটা চালের ভাতের সঙ্গে তেঁতুলপাতার ঝোল। পরমতৃপ্তিভরে তাই খেয়ে গৃহিণীকে প্রশ্ন করলেন, “ এই অপূর্ব আহার্য তুমি কি দিয়ে প্রস্তুত করলে? ” ব্রাহ্মণী তো অবাক। তিনি খুশিঝরা গলায় বলে উঠলেন, “ কেন নাথ, উঠোনের ওই তেঁতুলগাছের দিকে তাকিয়ে আপনিই তো সকালবেলায় বলে গেলেন। ” শুনে শিশুর মতো আনন্দে লাফিয়ে উঠলেন রামনাথ। দাওয়া থেকে উঠোনে নেমে তেঁতুলগাছের দিকে তাকিয়ে বললেন, “ ব্রাহ্মণী আমাদের আর চিন্তা নেই। গাছের তেঁতুলপাতা তো আর ফুরিয়ে যাবে না। এ বার আমি নিশ্চিন্ত মনে ন্যায়চর্চা করতে পারব।”
নৈয়ায়িক রামনাথ নবদ্বীপের বিদ্যাচর্চার ধারাটাই বদলে দিলেন তাঁর জ্ঞানের গৌরব দিয়ে। সে কালে নিয়ম ছিল পড়াশোনা শেষে নদিয়ারাজের দরবারে গিয়ে নিজের বিদ্যার পরিচয় দিয়ে নিষ্কর জমিসহ প্রভূত অর্থ সাহায্য পেতেন। তা দিয়ে টোল খুলে অধ্যাপনা শুরু করতেন। কিন্তু বুনো রামনাথ রাজার দরজায় গিয়ে সাহায্য ভিক্ষা করলেন না। তিনি বিদ্যাকে নিজের ভাল থাকার জন্য অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে চাননি। নবদ্বীপের এক জঙ্গলে ভরা স্থানে টোল স্থাপন করে নব্যন্যায়ের চর্চা শুরু করলেন। জ্ঞানচর্চা ছাড়া জীবনধারনের জন্য সম্বল কেবল ওই তেঁতুলপাতা আর মোটা চালের ভাত। কিন্তু সে সময়ে নবদ্বীপের টোলগুলিতে প্রথা ছিল সংস্কৃত পড়তে আসা ছাত্রদের কাছ থেকে অধ্যাপকেরা কোন বেতন নিতেন না। উপরন্তু তাঁদের ভরণপোষণের ভার বহন করতেন অধ্যাপক। কিন্তু বুনো রামনাথের নিজেরই জোটে না। তিনি ছাত্রদের ব্যয় বহন করবেন কি করে। কিন্তু তাঁর পাণ্ডিত্য ও অধ্যাপনা নৈপুণ্যের গুনে দিনে দিনে টোলে বিদ্যার্থীর সংখ্যা বাড়তে লাগল। দরিদ্র রামনাথ তাঁদের অসহায় ভাবে ছাত্রদের জানালেন তিনি অত্যন্ত দরিদ্র। তাঁদের খাওয়া-পরার ব্যবস্থা করার সামর্থ্য তাঁর নেই।
উত্তরে ছাত্ররা তাঁকে বলেছিলেন, “গুরুদেব আমরা বিদ্যার্থী হয়ে এসেছি, আহারার্থী হয়ে নয়। আমাদের ব্যবস্থা আমরা নিজেরাই করব। আপনি শুধু আমাদের পাঠদান করুন।” বলা হয় তারপর থেকেই নবদ্বীপের টোল পরিচালন ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটে। পণ্ডিতমশাইদের আর ছাত্রদের ভরণপোষণের ভার নিতে হত না। ‘নবদ্বীপে সংস্কৃত চর্চার ইতিহাস’ গ্রন্থে পণ্ডিত গোপেন্দুভূষণ সাংখ্যতীর্থ লিখেছেন, “নবদ্বীপের বিশ্ববিদ্যালয় এখনকারই মতো আবাসিক এবং পরীক্ষানিয়ামক থাকিলেও বিশ্ববিদ্যালয় বলিতে এখনকার যেরূপ ধারণা নবদ্বীপ বিশ্ববিদ্যালয় কিন্তু সে ধরনের ছিল না। নবদ্বীপ বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বাপেক্ষা বড় বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে এখানে ছাত্রগণ কোনও না কোন নির্দিষ্ট অধ্যাপকের অন্তেবাসী হইয়া থাকিত এবং অধ্যাপক গৃহেই অপত্যনির্বিশেষে প্রতিপালিত হইত।” তাঁর কথা মতো, “ছাত্রেরা শুধু গ্রন্থপাঠই করিত না, সন্ধ্যাবন্দনা পূজাহোম প্রভৃতি অনুষ্ঠান দ্বারা সংযম ও শিষ্টাচার শিক্ষায় আদর্শস্থানীয় হইতে পারিত। ছাত্র যত বুদ্ধিমানই হউক, ধর্ম পরায়ণ না হইলে তাঁর সমাদর হইত না।” সেকালের নবদ্বীপে আর একটি বৈশিষ্ট ছিল শিক্ষা সমাপ্তির কোন নির্দিষ্ট কাল ছিল না। যতদিন খুশি গুরুগৃহে থেকে শিক্ষালাভ করতে পারত। চূড়ান্ত পরীক্ষা হত নবদ্বীপের ‘বিদগ্ধজননী’ বা পোড়ামা তলায় সমবেত অধ্যাপকদের সামনে। রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায়ে লিখছেন, নদিয়ার রাজা রুদ্র রায়ের সময়ে নবদ্বীপে ৬০০ অধ্যাপক এবং ৪০০০ ছাত্র ছিলেন। সে বড় সুখের সময়।