nadia

বৌদ্ধ মূর্তিতে চোখ-মুখ প্রতিস্থাপন, শিবত্ব আরোপ

নবদ্বীপে শিবের গাজন হয়। পণ্ডিতদের মতে এই গাজন আসলে বৌদ্ধদের ধর্মগর্জন থেকে এসেছে। যার অর্থ নবদ্বীপ এক সময়ে বৌদ্ধ প্রভাবিত অঞ্চল ছিল। সেনরাজাদের পরবর্তী সময়ে এই মূর্তিগুলি শিবে রূপান্তরিত হয়। নবদ্বীপের প্রতিষ্ঠিত বেশির ভাগ শিবলিঙ্গে গৌরীপট্ট নেই।

Advertisement

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়

নবদ্বীপ  শেষ আপডেট: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০৬:২৮
Share:

শিবরাত্রি পালন চলছে কৃষ্ণনগরে। শুক্রবার। নিজস্ব চিত্র

শিবরাত্রির নবদ্বীপ দেখলে কে বলবে— এই জনপদেই একদা জন্মেছিলেন স্বয়ং চৈতন্যদেব!
বাংলা ক্যালেন্ডার যত শেষের দিকে যায় ততই নিজেকে বদলে বৈষ্ণবতীর্থ নবদ্বীপ হয়ে ওঠে আদ্যন্ত এক শৈব পীঠ। যদিও লোকসংস্কৃতি গবেষক পল্লব সেনগুপ্তের মতে, “একমাত্র বৈষ্ণব প্রভাবিত কিছু কিছু অঞ্চলের কথা বাদ দিলে বাঙালি সমাজ এবং সংস্কৃতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পুরুষ দেবতা হলেন শিব।” সেই ধারার ব্যতিক্রম নবদ্বীপ। চৈতন্যদেবের জন্মস্থান হলেও নবদ্বীপে শিবের উপাসনা প্রাক্ চৈতন্যযুগের বলেই মনে করেন গবেষকেরা।

Advertisement

নবদ্বীপের উদ্ভব নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে বিস্তর মতভেদ থাকলেও নবদ্বীপের বিদ্যাচর্চা এবং তন্ত্র সাধনার সঙ্গে বৌদ্ধ যোগাযোগ নিয়ে প্রায় সকলেই একমত। একই ভাবে সঙ্গে নবদ্বীপের শিব উপাসনার পিছনেও নাকি সেই বৌদ্ধ প্রভাব বর্তমান। তাই চৈতন্যধাম জুড়ে রয়েছে বহু শিব মন্দির। নবদ্বীপের চার দিকে রয়েছেন চার শিব। উত্তরে যুগনাথ বা যোগনাথ, দক্ষিণে আলোকনাথ, পুবে হংসবাহন এবং পশ্চিমে বুড়োশিব। এরা নবদ্বীপের দিক দেবতায় পরিণত হয়েছে। এছাড়াও রয়েছেন বালকনাথ, বাণেশ্বর, দণ্ডপাণি ও পলেশ্বর।

এ হেন এক শহর যে শিবরাত্রিতে মেতে উঠবে, তাতে আর আশ্চর্য কী! অধিকাংশ শহর বা গ্রামে একটি, বড় জোর দু’টি শিবমন্দির থাকে। যাদের ঘিরে শিবরাত্রিতে মেলা বসে। শিবের মাথায় জল ঢালেন ভক্তরা। কিন্তু নবদ্বীপের চতুর্দিক জুড়ে এত শিবমন্দির থাকায় উৎসবের আড়ম্বরে নবদ্বীপ এ দিন ছাপিয়ে যায় বাকিদের। শুধু শিবরাত্রি বলে নয়, চৈত্রমাস ভর এই সাত শিব নিয়েই মেতে ওঠে নবদ্বীপ। খর চৈত্রের দিনগুলো শিবের বিয়ে, গাজন, নীল, চড়কের মতো উৎসব সাড়ম্বরে পালিত হয়। সংক্রান্তির পাঁচ দিন আগে থেকে শুরু হয়ে যায় সাত শিবের গাজন উৎসব। শহরের কেন্দ্র স্থলে রয়েছে বিশালাকার শিব লিঙ্গ। ১৬৬৯ সালে প্রথমবার নদিয়ারাজ রাঘব মন্দির গড়ে এই শিব প্রতিষ্ঠা করেন। তবে গঙ্গার ভাঙনের ফলে সে মন্দির বিনষ্ট হয়। ১৮২৫ সালে তা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয়।

Advertisement

কিন্তু বৈষ্ণবপ্রধান নবদ্বীপে এত শিব এলেন কী ভাবে? এর জবাব মিলছে ১২৯১ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত কান্তিচন্দ্র রাঢ়ীর ‘নবদ্বীপ মহিমা’ বইয়ে। নবদ্বীপের ইতিহাস বিষয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই বইয়ে কান্তিচন্দ্র লিখছেন, “বর্ত্তমান কালে নবদ্বীপ নগর ও তৎসন্নিহিত স্থানগুলি হিন্দু প্রধান। ইহা হিন্দুদিগের তীর্থস্থান। এখানে অনেক দেবদেবীর মন্দির আছে; কিন্তু নিরীক্ষণ পূর্বক দেখিলে এই সকল দেবমূর্ত্তির অনেকগুলিকেই বৌদ্ধমূর্ত্তি বলিয়া প্রতীয়মান হয়। এখানকার অনেক ষষ্ঠী, শীতলা, শিব, মনসা ও মঙ্গলচণ্ডী প্রভৃতি দেবদেবী বৌদ্ধ স্তূপ চৈত্যাদির নামান্তর মাত্র।” কান্তিচন্দ্রের অনুমান, ওই সব মূর্তিগুলি অশোক বা হর্ষবর্ধনের রাজত্ব কালে কোনও বিহারে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

নবদ্বীপে শিবের গাজন হয়। পণ্ডিতদের মতে এই গাজন আসলে বৌদ্ধদের ধর্মগর্জন থেকে এসেছে। যার অর্থ নবদ্বীপ এক সময়ে বৌদ্ধ প্রভাবিত অঞ্চল ছিল। সেনরাজাদের পরবর্তী সময়ে এই মূর্তিগুলি শিবে রূপান্তরিত হয়। নবদ্বীপের প্রতিষ্ঠিত বেশির ভাগ শিবলিঙ্গে গৌরীপট্ট নেই। লোড়াকৃতি বা কিছুটা গোলাকার ওই মূর্তিগুলি বৌদ্ধদের উপাস্য হলেও তা নিশ্চিত ভাবে শিব হিসাবে পূজিত হত না। পরবর্তী কালে বৌদ্ধধর্ম ক্ষয় পেতে শুরু করে, অন্য দিকে বিজয় সেন নবদ্বীপে রাজত্ব স্থাপন করেন। প্রবল পরাক্রান্ত সেন রাজবংশের সময় থেকেই নবদ্বীপে তন্ত্রের প্রভাব বাড়তে শুরু করে। সেই সময়ে তন্ত্র বা শক্তি সাধনার অঙ্গ হিসাবে ভৈরবী এবং ভৈরব বা শিবের উপস্থিতি অনিবার্য হয়ে ওঠে। বৌদ্ধ মূর্তিগুলিতে চোখ মুখ প্রতিস্থাপন করে শিবত্ব আরোপ করা হয়।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement