মাঘের রাতে সুনসান হয়ে গিয়েছিল গোটা পাড়া।
গুঞ্জন ও গোঙানি ভেসে আসছিল রফিক দফাদারের বাড়ি থেকে। কৃষ্ণনগরের দুর্গাপুর তরফদার পাড়ার একচিলতে উঠোনে গুটিকয়েক লোকের ভিড়। বারান্দায় টাঙানো ডুমো বাল্বের নীচে উদ্বিগ্ন মুখে বসেছিল পাশের বাড়ির আজাদ মণ্ডলের পরিবার। কেন?
উত্তরটা এসেছিল সমস্বরে, ‘‘ঘরের মধ্যে ওঝা আজাদের চিকিচ্ছে করছে যে!’’ কেমন সে চিকিৎসা?
আজাদের পরিবারের অভিযোগ, ঘরের দরজা-জানালা ভিতর থেকে বন্ধ। সেই বন্ধ ঘরে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে ধুনো। ধোঁয়ার চোটে কাশির দমক থামছে না আজাদের। অথচ সে দিকে কারও কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই। ওঝা ও তার লোকজন প্রথমে দড়ি ও গামছা দিয়ে বেঁধে ফেলে আজাদের হাত-পা। হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে এক জন। তার পর কঞ্চি, লাঠি ও লোহার রড দিয়ে শুরু হয় বেদম মার। জিন ছাড়ানোর সেটাই নাকি চিকিৎসা!
মার খেতে খেতে কুঁকড়ে যাওয়া লোকটার গোঙানি আর সহ্য করতে পারেনি আজাদের আত্মীয়েরা। জোর করে দরজা খুলে ফেলেন তাঁরা। বেগতিক বুঝে চম্পট দেয় বাড়ির মালিক রফিক দফাতার, ওঝা ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গ। রবিবার রাতের ওই ঘটনার পরে রফিক ও ওঝার বিরুদ্ধে থানায় মামলা দায়ের করেছেন আজাদের পরিবার। গুরুতর জখম অবস্থায় আজাদ এখন শক্তিনগর জেলা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
হাসপাতালে শুয়ে তিনি বলছেন, ‘‘আর একটু হলে তো মরেই যেতাম! পায়ের পাতা ও কোমরের নীচে খুব মেরেছে। মুখ চেপে ধরায় চিৎকারও করতে পারছিলাম না।’’ পুলিশের এক কর্তা বলছেন, ‘‘অভিযুক্তদের খোঁজে তল্লাশি শুরু হয়েছে।’’
বছর চল্লিশের তরতাজা আজাদ অভাবের সংসারেও দিব্যি হইহই করে বেঁচে থাকতেন। কিন্তু কিছু দিন থেকে কেমন যেন বদলে গিয়েছিলেন। একা একাই কথা বলতেন। কাঠফাটা রোদে খেতের কাজ সেরে বাড়ি ফিরে স্নান করতে চাইতেন না। রাতের ঘুম উধাও। খিদে পেত না। মাতব্বরেরা বললেন, ‘‘আজাদকে তো জিনে ধরেছে রে!”
প্রথমে অবশ্য ওঝা ডাকেনি আজাদের পরিবার। তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল কৃষ্ণনগরে এক মনোবিদের কাছে। ওষুধে কাজও করছিল। কিন্তু গোল বাধল ওষুধ খাওয়া বন্ধ করায়। আজাদের স্ত্রী আঙ্গুরি বিবি বলছেন, ‘‘লোকজন বলল জিনেই নাকি ওষুধ খেতে দিচ্ছে না। তাই ওঝা ডেকেছিলাম। টাকাও নেয় বিস্তর। কিন্তু ঝাড়ফুঁকের নাম করে এটা কী করল বলুন তো!’’
জেলা প্রশাসনের এক কর্তা বলছেন, ‘‘ঢের হয়েছে। এ সব দেখেশুনে এ বার অন্তত এই সংস্কারগুলো মুছে ফেলুক গ্রামের মানুষ।’’