bjp

অ্যাম্বুল্যান্স নিয়ে চাপে পদ্ম শিবির

অ্যাম্বুল্যান্সটিকে রাস্তা করে দেওয়া দূরের কথা, দিলীপ মঞ্চ থেকে বারবার বলতে থাকেন, ‘‘এখান দিয়ে যেতে দেওয়া যাবে না। ডিসটার্ব হয়ে যাবে। ঘুরিয়ে অন্য দিক দিয়ে নিয়ে যান।’’

Advertisement

সুস্মিত হালদার 

কৃষ্ণনগর  শেষ আপডেট: ১০ জানুয়ারি ২০২০ ০২:৫০
Share:

কৃষ্ণনগরে রাস্তা জুড়ে বিজেপির সেই সভা। অ্যাম্বুল্যান্স ঘুরিয়ে নিতে বলছেন দিলীপ ঘোষ। বৃত্তের মধ্যে সেই অ্যাম্বুল্যান্স। সোমবার। ফাইল চিত্র

রাজ্য সভাপতি যতই তর্জন-গর্জন করে বলুন, সভাস্থলে আটকে পড়া অ্যাম্বুল্যান্সে চালক ছাড়া কেউ ছিলেন না, প্রবল অস্বস্তিতে পড়েছে নদিয়া জেলা বিজেপি। ঘনিষ্ঠ মহলে নেতারা সে কথা স্বীকারও করছেন। কারণ শেষমেশ সাধারণ মানুষের প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে তাঁদেরই।

Advertisement

একে তো এই অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটেছে, তার উপরে সংবাদমাধ্যমের জেরার মুখে পড়ে দিলীপ যে ভাবে প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন তাতে জেলার নেতাদের অস্বস্তি আরও বেড়েছে। রাজ্য সভাপতির ‘সত্যি’ বলার ঠেলায় বেসামাল হয়ে তাঁরা অনেকেই এখন অসংলগ্ন এবং পরস্পরবিরোধী মন্তব্যও করছেন

সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের সমর্থনে সোমবার কৃষ্ণনগর শহরে দিলীপের নেতৃত্বে মিছিল করেছিল বিজেপি। সেই মিছিল এসে থামে জেলা প্রশাসনিক ভবনের সামনে। রাস্তার ধারে মঞ্চ বাঁধা হয়েছিল। নেতা গিয়ে মঞ্চে ওঠেন। রাস্তা জুড়ে ছড়িয়ে বসে পড়ে কয়েক হাজার কর্মী। দিলীপ যখন উত্তেজক বক্তৃতা করছেন, একটি অ্যাম্বুল্যান্স ধুবুলিয়া থেকে প্রসূতিকে নিয়ে এক ধারে এসে দাঁড়ায়।

Advertisement

অ্যাম্বুল্যান্সটিকে রাস্তা করে দেওয়া দূরের কথা, দিলীপ মঞ্চ থেকে বারবার বলতে থাকেন, ‘‘এখান দিয়ে যেতে দেওয়া যাবে না। ডিসটার্ব হয়ে যাবে। ঘুরিয়ে অন্য দিক দিয়ে নিয়ে যান।’’ অ্যাম্বুল্যান্সের ভিতরে প্রসূতি পাপিয়া বিবি তখন যন্ত্রণায় ছটফট করছেন। তাঁর মা সাহিনুর মিস্ত্রি এবং অ্যাম্বুল্যান্স চালক রথীন্দ্রনাথ বিশ্বাস বারবার অনুরোধ করলেও সভার লোকেরা রাস্তা ছাড়েনি। বরং নেতার কথা শুনে কয়েক জন মহা উৎসাহে অ্যাম্বুল্যান্সটি পিছন দিকে ঠেলতে থাকে। বাধ্য হয়ে চালক অ্যাম্বুল্যান্স ঘুরিয়ে নেন। তাঁদের গন্তব্য নদিয়া জেলা সদর হাসপাতাল ঘটনাস্থল থেকে মাত্র এক মিনিটের পথ। ঘুরপথে চক্কর খেয়ে ২৫ মিনিট পরে তাঁরা হাসপাতালে পৌঁছন।

অ্যাম্বুল্যান্স যখন ঘুরে চলে যাচ্ছে, তখনও দিলীপ মঞ্চ থেকে দাবি করতে থাকেন, তাঁর সভায় উৎপাত করার জন্যই পরিকল্পনা করে অ্যাম্বুল্যান্সটি পাঠানো হয়েছিল। বিষয়টি ধামাচাপা দিতে প্রথমে বিজেপি নেতারা দাবি করছিলেন, অ্যাম্বুল্যান্সে কোনও রোগী ছিল না বলে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। পরে প্রসূতি থাকার কথা জানাজানি হওয়ায় তাঁরা চাপে পড়ে যান।

বৃহস্পতিবারই হাসপাতালে ভর্তি থাকা পাপিয়া ও তাঁর মায়ের ছবি দিয়ে সংবাদপত্রে খবর প্রকাশিত হয়েছে। তবে পুরোটাই তৃণমূলের ভোট-কুশলী প্রশান্ত কিশোরের পরিকল্পনা বলে দাবি করে দিলীপ বলেছেন, ‘‘সকলেই দেখেছে, ওই অ্যাম্বুল্যান্সে চালক ছাড়া কেউ ছিল না। ধমক দেওয়ার পরে সে রাস্তার এক পাশে অ্যাম্বুল্যান্স দাঁড় করিয়ে আমার বক্তৃতা শুনছিল।’’

রাজ্যনেতা যতই ‘সত্যি’ কথা বলুন, জেলার নেতারা বুঝতে পারছেন যে জনমানসে যে এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। দলের অনেক কর্মী-সমর্থকও বিষয়টি ভাল ভাবে নিচ্ছেন না। এর মধ্যে মঙ্গলবারই কোতোয়ালি থানার পুলিশ দিলীপের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করেছে। তবে এ দিন পর্যন্ত বিজেপির কোনও নেতা হাসপাতালে ভর্তি থাকা পাপিয়া বা তাঁর মায়ের সঙ্গে দেখা করেননি, ক্ষমা চাওয়া তো দূরস্থান।

ঘটনার সময়ে মঞ্চেই ছিলেন বিজেপির নদিয়া উত্তর সাংগঠনিক জেলা সভাপতি আশুতোষ পাল। তিনিই প্রথম দাবি করেন, অ্যাম্বুল্যান্সে চালক ছাড়া কেউ ছিলেন না। এ দিন তিনি স্বীকার করেন, সাংগঠনিক ভাবে খোঁজ নিয়ে তাঁরা জেনেছেন যে ভিতরে প্রসূতি ছিল। তা হলে কেন রাস্তা জুড়ে বসে থাকা কর্মীদের সরিয়ে দিলীপ অ্যাম্বুল্যান্স যাওয়ার জায়গা করে দিলেন না? আশুতোষের দাবি, “ওই ভিড়ের মধ্যে আমরা সত্যিই বুঝতে পারিনি যে ভিতরে প্রসূতি আছে। ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারলে আমাদের কর্মীরা রাস্তা করে দিতেন।”

প্রসূতি পাপিয়া বিবি বুধবারই প্রশ্ন তুলেছিলেন, যিনি মাইকে ঘুরপথে যাওয়ার কথা বলেছেন, তাঁরও হয়তো মা-বোন আছে। তাঁদের কাউকে যদি এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হত, কী করতেন? ওই মিটিংয়ে যে মহিলারা আছেন, তাঁরাই বা কেন এগিয়ে এসে অ্যাম্বুল্যান্স যাওয়ার জন্য রাস্তা করে দিলেন না? আশুতোষ বলেন, “এটা নিজের বা পরের বাড়ির লোকের ব্যাপার নয়। অ্যাম্বুল্যান্সে প্রসূতি আছে জানতে পারলে নিরাপদে হাসপাতালে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করতাম।”

পাপিয়ার মাকে হাতজোড় কাঁদতে দেখেও অ্যাম্বুল্যান্সের সামনে থাকা বিজেপি কর্মীরা কেন মঞ্চ থেকে উড়ে আসা নির্দেশে অ্যাম্বুল্যান্সটিকে পিছন দিকে ঠেলছিলেন, সেই প্রশ্নের অবশ্য সদুত্তর মেলেনি। রানাঘাটের বিজেপি সাংসদ জগন্নাথ সরকার অবশ্য যুক্তি দিচ্ছেন, “সভায় তখন যা ভিড় ছিল, অত মানুষকে সরিয়ে রাস্তা করতে অনেক সময় লেগে যেত। তার চেয়ে অন্য পথে প্রসূতি অনেক তাড়াতাড়ি হাসপাতাল পৌঁছে গিয়েছেন।” তাঁর দাবি, “মানবিক কারণেই দিলীপদা অন্য পথ দিয়ে যেতে বলেছিলেন। আমার পরিবারের কেউ হলেও একই কাজ করা হত।”

পাপিয়া প্রশ্ন তুলেছেন, ওই সময়ে বিজেপির অনেক মহিলা কর্মীও ঘটনাস্থলে ছিলেন। তাঁরা কেন রাস্তা করে দেওয়ার জন্য নেতাদের অনুরোধ করলেন না? সভায় ছিলেন বিজেপির নদিয়া উত্তর সাংগঠনিক জেলা মহিলা মোর্চার সভাপতি সঞ্জিতা মজুমদার। প্রশ্ন শুনে খানিক চুপ করে থেকে তিনি বলেন, “ঘটনাটা ঘটেছে মঞ্চের ডান দিকে। আমরা ছিলাম বাঁ দিকে। তাই আমরা জানতে পারিনি। জানলে, ঠিক রাস্তা করে দিতাম।” অ্যাম্বুল্যান্সটিকে ফিরিয়ে দেওয়া কি উচিত হয়েছে? সঞ্জিতা বলেন, “বিষয়টা আরও ভাল করে না জেনে কিছু বলব না। তবে অ্যাম্বুল্যান্সে প্রসূতি আছে জানলে, রাস্তা করে দেওয়াই উচিত।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement