চেনা প্যাকেটে ডিম-পাঁউরুটি আর একটা ছোট্ট মিষ্টি, বেলা বাড়লে ঘন ঝোলের ডিম-ভাত। জেলার প্রান্ত থেকে বাসে গাদাগাদি করে ভোরের আগেই গন্তব্যে পৌঁছে যাওয়া ভোট-সেনারা তা হলে কি পেটের তাগিদেই, হাতে খেটো বাঁশ কিংবা রঙিন উইকেট নিয়ে পাহারায় বসে পড়ছেন?
ধুবুলিয়ার সফিকুল ইসলাম বছর সাতেক ধরে শাসক দলে রয়েছেন, পাড়ায়, পড়শি গ্রামে মারকুটে এবং ঈষৎ জঙ্গি পার্টি-ওয়ার্কারের শিরোপা ইতিমধ্যেই কপালে জুটেছে তাঁর। ডিম-ভাতের থালাটা ঠেলে দিয়ে বলছেন, ‘‘শুধু কি খেতে আসা, নেতাদের নজরে পড়লে উপরি পাওনা। পাড়ায় একটু বেশি পাত্তা পাওয়া, বোঝেন তো সবই!’’
সেই সব ‘বোঝা’র আড়ালে, ভোট সেনাদের দিয়েই এ বার বিরোধী মনোনয়ন প্রায় রুখে দিয়েছে তৃণমূল। বিরোধীরা সমস্বরে অভিযোগ করছেন, বিডিও থেকে এসডিও— মনোনয়ন দাখিলের সব পথেই বাঁশের ব্যারিকেড ঝুলিয়ে বিরোধী রুখে দশে দশ পেয়ে দলের হাততালি কুড়িয়েছে ভোট-সেনারা। মুর্শিদাবাদ জেলা তৃণমূলের এক তাবড় নেতা বলছেন, ‘‘পরিকল্পনার ব্লু-প্রিন্ট তৈরি হয়েছিল আগেই। এ বার তার প্রয়োগটা হয়েছে যথাযথ। আমরা সফল।’’ মুর্শিদাবাদেরলালবাগ এলাকার তেমনই এক ভোট সেনা জব্বর আলি বলছেন, ‘‘আমার নাম দিয়ে লিখুন না, কে চিনছে আমায়, পুলিশ? কাঁচকলা করবে। বরং ‘দাদা’র কথা মতো কাজ করতে পারলে ভবিষ্যতে একটা হিল্লে হতে পারে।’’ সে জন্য মারপিট, হাঙ্গামা, অস্ত্র ধরা কোনও কিছুতেই বাধা নেই তার।
তবে এ সব ‘আত্মকথা’ বাদ দিলে দলে নেতারা কি বলছেন? কল্যাণী এলাকার এক ব্লক তৃণমূল নেতা বলছেন, ‘‘দলের উপরতলার নির্দেশ, যা করতে বলবে তাই করতে হবে!’’ তবে স্থানীয় নেতা প্রসেনজিৎ গুহ ধরিয়ে দিচ্ছেন, ‘‘তবে বাইরে থেকে আসা দলীয় কর্মীদের খাইয়ে-পরিয়ে রেখেছি আমরা। একেবারে পিকনিকের মেজাজে। নওপাড়া-১ ও নওপাড়া-২ পঞ্চায়েত থেকে হাজার খানেক কর্মী এসেছিলেন, সকলেই প্রার্থীদের সমর্থনে। তাঁদের খাবারের ব্যবস্থা তো করতেই হবে!’’
ছবিটা প্রায় একই ভঙ্গিতে ‘পিকনিকের মেজাজ’ মুখী করে দিচ্ছেন লালবাগের এক তাবড় তৃণমূল নেতাও। বলছেন, ‘‘দূর থেকে ঠেঙিয়ে এসেছেন কর্মীরা, ওঁদের তো খাওয়া-দাওয়া কিঞ্চিৎ তোয়াজের ব্যবস্থা তো করতেই হবে!’’ কিন্তু কেন এনেছেন ওঁদের? খানিক আমতা করে বলছেন, ‘‘সব তো বলতে পারব না, ধরে নিন ওঁরা দলীয় প্রার্থীদের সমর্থনে এসেছেন।’’ সেই অকাল পিকনিকে ঘামতে ঘামতে এক ভোট সেনা বলছেন, ‘‘সবাই যে স্বেচ্ছায় এসেছে, এমনটা বলতে পারব না। তবে কি জানেন তো বাঁচতে গেলে কিছু কাজ অনিচ্ছা নিয়েও করতে হয়!’’ আর সে কাজ করতে গিয়ে হাতে অস্ত্র নিয়ে— ভাতে কাঁকড়, মাংসে ঝাল হলে ভাল হত কিংবা সকালেও একটা ‘টিফিনের’ ব্যবস্থা রাখা উচিৎ, এ সব নিয়েও দেদার আলোচনা করছে ভোট-সেনারা। আর বিরোধীরা? শাসক দলের এক নেতা হাসতে হাসতে বলছেন, ‘‘ওরা ওই যে দাঁড়িয়ে আছে, ব্যারিকেডের ও পারে!’’