বেদনা নিয়েই কৃষ্ণনগর মাতল বারোদোলে

সব কিছু ঠিক সেই আগের মতো। নদিয়া রাজবাড়ির নাটমন্দিরের খিলানের নীচে বারোটি কাঠের সিংহাসনে রয়েছে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের আমলের নানা কৃষ্ণবিগ্রহ। ব্যতিক্রম কেবল একটি সিংহাসন। বারোদোলের প্রধান আকর্ষণ গোপীনাথকে গত বছর থেকে ফেরায়নি অগ্রদ্বীপ। তাই কষ্টিপাথরে গড়া মূর্তির বদলে দ্বাদশতম সিংহাসনে পটের গোপীনাথ!

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

নবদ্বীপ শেষ আপডেট: ০১ এপ্রিল ২০১৫ ০১:০০
Share:

কৃষ্ণনগরে শুরু হয়েছে বারোদোলের মেলা। —নিজস্ব চিত্র।

সব কিছু ঠিক সেই আগের মতো। নদিয়া রাজবাড়ির নাটমন্দিরের খিলানের নীচে বারোটি কাঠের সিংহাসনে রয়েছে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের আমলের নানা কৃষ্ণবিগ্রহ। ব্যতিক্রম কেবল একটি সিংহাসন। বারোদোলের প্রধান আকর্ষণ গোপীনাথকে গত বছর থেকে ফেরায়নি অগ্রদ্বীপ। তাই কষ্টিপাথরে গড়া মূর্তির বদলে দ্বাদশতম সিংহাসনে পটের গোপীনাথ!

Advertisement

রাজপরিবারের উত্তরসূরিরা অনেক চেষ্টা করেছেন গোপীনাথকে ফিরিয়ে আনতে। এমনকী বারোদোলের মেলায় তৈরি হয়েছিল নাগরিক মঞ্চও। কিন্তু তাতেও গোপীনাথকে ফেরানো যায়নি। কিন্তু নাগরদোলা, হরেক রকম পসরা সাজানো দোকান, আলোর রোশনাই আর প্রচুর মানুষের উপস্থিতি দেখে তা বোঝার উপায় নেই। বারোদোলের মেলা সেই আগের মতোই।

চৈতন্যদেবের নির্দেশে গোবিন্দ ঘোষ প্রতিষ্ঠিত অগ্রদ্বীপের গোপীনাথ নদিয়ার মানুষের বড় প্রিয়। তাঁর টানেই কয়েক শতাব্দী আগে কোন এক চৈত্রে জমে উঠেছিল বারোদোলের মেলা। তারপর দিন যত গড়িয়েছে ততই লোকমুখে ছড়িয়েছে মেলার খ্যাতি। প্রাচীনত্ব এবং জনপ্রিয়তার বিচারে এ তল্লাটে বারোদোলের মেলার কোনও জুড়ি নেই।

Advertisement

ঠিক কবে থেকে, কার আমলে বারোদলের মেলা শুরু হয়েছিল তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। গবেষকদের অনুমান, নদিয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্র আনুমানিক ১৭৬৪ সাল নাগাদ বারোদোলের মেলা প্রবর্তন করেন। রংদোলের পরে একমাত্র কৃষ্ণনগরেই রাধাকৃষ্ণের বারোদোলের মেলা অনুষ্ঠিত হয়। ‘হরিভক্তিবিলাস’ গ্রন্থে এই দোলের উল্লেখ পাওয়া যায়— ‘চৈত্রে মাসি সিতে পক্ষে দক্ষিণাভিমুখং হরিম/ দোলারূঢ়ং সমভ্যরচ্য মাসমান্দোলয়েৎ কলৌ।’ অর্থাৎ চৈত্রমাসের শুক্লা একাদশী তিথিতে দক্ষিণমুখ করে হরি বিগ্রহকে পূজার্চনা করে একমাস দোলনায় দোলাতে হয়। শাস্ত্রজ্ঞ নদিয়ারাজ শাস্ত্র মেনেই সূচনা করেছিলেন বিরল এই বারোদোল উৎসবের। বারোটি বিগ্রহের দোল তাই বারোদোল। বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার- নদিয়া, ১৯১০ সালের রিপোর্টে লিখেছিল— ‘সে বারে বারোদোলের মেলায় ২০ হাজার মানুষের সমাগম হয়েছিল এবং মেলা রাজবাড়ির হলেও তাতে সাধারণ মানুষই প্রধান ভূমিকা নিয়ে থাকেন।’ এহেন বারোদোলের মেলায় গোপীনাথ না থাকার জন্য যে আশঙ্কার মেঘ জমেছিল এ বার তা অনেকটাই কেটে গিয়েছে।

রাজবাড়ির বর্তমান প্রধান সৌমীশচন্দ্র রায় বলেন, “কে বলেছে গোপীনাথ অনুপস্থিত? মেলার লাখো মানুষের ভিড়ে ভক্তেরা তাঁদের প্রিয় দেবতাকে খুঁজে পেয়েছেন।”

রাজ পরিবারের বধূ অমৃতা রায় বলেন, “আমরা নানা দিক দিয়ে চেষ্টা করেও গোপীনাথ ফেরাতে পারিনি। বাধ্য হয়ে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছি। বাকিটা গোপীনাথ ভরসা।” মঙ্গলবার থেকে শুরু হল কৃষ্ণনগরে গোপীনাথহীন বারোদোলের মেলা।

রাজবাড়ির চকের মাঠের বেশ কয়েক হাজার বর্গমিটার জুড়ে মেলা প্রাঙ্গন সেজে উঠেছে। মেলার একটা বড় অংশ জুড়ে একটি সংস্থার বাজার। সেখানে বাংলাদেশ থেকে শুরু করে দেশের প্রায় সবকটি রাজ্যের হস্তশিল্পের জমজমাট বিকিকিনি চলে। সংস্থার তরফে সঞ্জন দাস বলেন, “সব মিলিয়ে মোট ৬৫টি স্টল নিয়ে এ বারে বাজার বসেছে।’’ গোপীনাথ না আসার কারণে মেলা নিয়ে যে আশঙ্কা ছিল, মেলায় ভিড় জমায় তা অনেকটাই দূর হয়েছে ব্যবসায়ীদের। তবে এবারে মেলায় সার্কাস না থাকায় অনেকেরই মনখারাপ।

রাজবাড়ির পঙ্খের কাজ করা ঠাকুর দালানের দক্ষিণদিকে চাঁদনি। সেখানেই বারোদোলের মূল মঞ্চ। নদিয়ারাজের কুলবিগ্রহ বড় নারায়ণ। বারোদোলের মেলায় বড় নারায়ণকে নিয়ে এতদিন মোট ১৩ বিগ্রহ থাকত — বলরাম, শ্রীগোপীমোহন, লক্ষ্মীকান্ত, ছোট নারায়ণ, ব্রহ্মণ্যদেব, গড়ের গোপাল, গোপীনাথ, নদিয়া গোপাল, তেহট্টের কৃষ্ণরায়, কৃষ্ণচন্দ্র, শ্রীগোবিন্দদেব ও মদনগোপাল। এ বারও নেই গোপীনাথ।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement