Dacoity in Ranaghat

জং ধরা রিভলভার, নিশানা নিপুণ, ১০২ কেজি ওজন নিয়ে দৌড়ে রানাঘাটে ডাকাত ধরলেন এএসআই

রানাঘাটে গয়নার শোরুমের এক নিরাপত্তাররক্ষী থানায় ফোন করে জানান ডাকাত ঢুকে পড়েছে। একটুও সময় নষ্ট না করে গাড়ির চালক-সহ চার জন লাঠিধারী পুলিশকে নিয়ে এএসআই রতন রায় ছুটে যান ঘটনাস্থলে।

Advertisement

প্রণয় ঘোষ

রানাঘাট শেষ আপডেট: ৩০ অগস্ট ২০২৩ ১৫:২৮
Share:

এএসআই রতন রায় (বাঁ দিকে)। মঙ্গলবার ডাকাতদলকে ধাওয়া করার দৃশ্য (ডান দিকে)। — নিজস্ব চিত্র।

দিনেদুপুরে শহরের রাস্তায় গুলির শব্দ। জানলা দিয়ে উঁকি দিচ্ছিলেন কয়েক জন গৃহস্থ। তাঁদেরই কেউ এক জন মোবাইলে যে ভিডিয়ো করলেন, তাতে দেখা গেল রিভলভার হাতে সশস্ত্র কয়েক জনের পিছু নিয়েছেন এক জন। গায়ে পুলিশের উর্দি ছিল না। তাই স্থূলকায় মানুষটি কে, তা কেউই বোঝেননি। তবে রানাঘাটে ডাকাতদলের চার সদস্যকে গ্রেফতারের পর ওই ‘মোটা লোকটাকে’ নিয়ে কৌতূহল বেড়েছে। তিনি রতন রায়। রানাঘাট থানার এএসআই। দুষ্কৃতীদের অত্যাধুনিক অস্ত্র থেকে ছোড়া গুলির সামনে যিনি অকুতোভয়। যিনি জং ধরা রিভলভার দিয়ে গুলির প্রত্যুত্তর দিয়েছেন।

Advertisement

ওজন ১০২ কিলোগ্রামের আশপাশে। গড়পড়তা শারীরিক উচ্চতায় এই অতিকায় শারীরিক গঠন নিয়ে প্রায়শই সহকর্মীদের ঠাট্টা-তামাশা শোনেন। তবে মঙ্গলবার দুপুরে যে কাণ্ড তিনি ঘটিয়েছেন, তাতে পুলিশ সুপারও রতনকে নিয়ে গর্বিত। ব্যারাকপুর সেন্টারের ১৯৯৬ ব্যাচের কনস্টেবল থেকে সদ্য পদোন্নতি পাওয়া এএসআই রানাঘাটে ডাকাতদলের ছোড়া মুহুর্মুহু গুলির সামনে পড়েও পিছু হঠেননি। বরং চার দুষ্কৃতীকে প্রায় ৫০০ মিটার ধাওয়া করেছেন। দু’জনকে ঘায়েল করেছেন তাঁর হাতের ওই জং ধরা রিভলভার দিয়ে।

কী ভাবে পারলেন? রতন বলছেন, তখন কার হাতে কোন অস্ত্র কিছুই নাকি তাঁর মাথায় ছিল না। এএসআইয়ের কথায়, ‘‘একটাই কথা মাথায় ঘুরছিল— পুলিশের সম্মান।’’ তাঁর গুলি পায়ে লেগে দুই ডাকাত ধরা পড়ে পুলিশের হাতে। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার হয় জুয়েলারি শোরুম থেকে লুট হয়ে যাওয়া বহুমূল্যের গয়না।

Advertisement

রানাঘাট থানার এএসআই রতন রায়। — নিজস্ব চিত্র।

মঙ্গলবার বিকেলে তাঁর রিভলভার হাতে ডাকাতদলের পিছু নেওয়া ভিডিয়ো ভাইরাল হতেই শুভেচ্ছার বন্যা বইছে। পুলিশকর্তাদের পিঠ চপড়ানি থানার রতনবাবুকে উৎসাহিত করছে। যদিও ছড়িয়ে পড়া ভিডিয়ো এবং সংবাদমাধ্যমে চোখ রেখে ভয় পেয়ে গিয়েছেন লালবাগে থাকা রতনের স্ত্রী মিঠু। কয়েক বার ফোন করার পর স্বামীর গলা শুনে উদ্বেগ কমেছে। দুই সন্তান তখন আদুরে গলায় বাবাকে ফেরার সময় চকলেট নিয়ে যাওয়ার আবদার জানিয়েছে। অত্যাধুনিক অস্ত্রে ‘সজ্জিত’ ডাকাতদলের সঙ্গে ‘অসম লড়াইয়ে’ অসাধ্যসাধন করে রতন বলছেন, ‘‘পুলিশের মান বাঁচাতেই হতো।’’

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, মঙ্গলবার বেলা ৩টে ১০ মিনিট নাগাদ রানাঘাট থানায় টেবিল ডিউটির দায়িত্বে ছিলেন এএসআই রতন। রানাঘাটের গয়নার শোরুমের এক নিরাপত্তাররক্ষী থানায় ফোন করে জানান যে, একদল ডাকাত ঢুকে পড়েছে তাঁদের দোকানে। আর সময় নষ্ট করেননি রতন। গাড়ির চালক-সহ চারজন লাঠিধারী পুলিশ নিয়েই তিনি ছুটে গিয়েছেন ঘটনাস্থলে। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে ঝটপট লুট করে বেরিয়ে পড়েছিল ডাকাতেরা। পুলিশের দিকে পর পর তিন রাউন্ড গুলি ছোড়ে তারা। ডাকাতদলের অত্যাধুনিক স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্রের মুহুর্মুহু গুলির মাঝে অসহায়ের মত লুকিয়ে পড়তে হয়েছিল লাঠিধারী পুলিশকর্মীদের। কিন্তু হাল ছাড়েননি রতন। কোমর থেকে পুরনো রিভলভার বার করে ডাকাতদলকে জবাব দেন তিনি। অল্পবয়সি ছিপছিপে চেহারার চার সদস্যকে প্রায় ১০২ কেজি ওজন নিয়ে টেক্কা দেন রতন। তাঁর চার রাউন্ড গুলির মধ্যে দুটি গুলিতে গুরুতর জখম হয় ডাকাতদলের দুই সদস্য। ওই দু’জন লুটিয়ে পড়তেই ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় বাকি দু’জন।

তত ক্ষণে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়েছেন বেশ কয়েক জন পুলিশ আধিকারিক। আসে সশস্ত্র পুলিশ। তার পর গ্রেফতার হয় আহত দুই ডাকাত-সহ মোট চার জন। উদ্ধার হয় দুটি মোটর বাইক, নগদ তিন লক্ষ ৭০ হাজার টাকা, চারটি অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র, একাধিক ভুয়ো-নথি। হাঁফ ছাড়েন অকুতোভয় রতন।

মঙ্গলবারের ‘অপারেশন’ নিয়ে রতন বলেন, ‘‘খবর পাওয়া মাত্র মাথায় ঘুরছিল, কোনও ভাবে যেন পালাতে না পারে ডাকাতরা। ভেবে নিই, যে ভাবেই হোক আমাকে পুলিশের সম্মান বাঁচাতেই হবে।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘ভয় হয়নি। তবে আশঙ্কা ছিল ডাকাতদের বাগে আনার আগেই না গুলি শেষ হয়ে যায়!’’

রতনের বাবা অবসরপ্রাপ্ত পুলিশকর্মী। স্ত্রী এবং দুই সন্তান থাকেন মুর্শিদাবাদের লালবাগের বাড়িতে। রতনের কীর্তিতে গর্বিত গোটা পরিবার। রতনের ছোটবেলাকার বন্ধু, লালবাগ স্কুলের সহপাঠী মঞ্জুল সরকারের কথায়, ‘‘ও মোটাসোটা বলে আমরা মাঝে মাঝেই ঠাট্টা করি। ভোটের মধ্যেই তো বলেছিলাম, ‘বোমা মারলে পালাতে পারবি তো?’ কিন্তু ও আজ প্রমাণ করে দিল রতন আসলে আমাদের রত্ন।’’

এএসআই রতন রায়কে নিয়ে রানাঘাট পুলিশ জেলার সুপার কে কান্নান বলেন, ‘‘রতন-সহ গোটা দল যে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে, তার জন্য প্রত্যেককে জেলা পুলিশ সুপার হিসাবে ধন্যবাদ জানালাম। আর রতন বাবুর লড়াইটা ছিল চোখে পড়ার মতো। পুলিশ জেলা ওঁদের জন্য গর্বিত।’’ এ সব শুনে রতনের স্ত্রী বলছেন, ‘‘গর্ব তো হচ্ছেই। তবে চিন্তাও হয়। ছবিগুলো দেখছি আর আঁতকে উঠছি। যদি একটা গুলি ওর লেগে যেত!’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement