আজ, বুধবার থেকে ফের চালু লোকাল ট্রেন। তার মহড়া হয়ে গেল মঙ্গলবারেই। কৃষ্ণনগরে। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য
গড়িয়ে গেল বন্ধ চাকা। আট মাস অনড় পড়েছিল মাইলের পর মাইল ইস্পাতের রেখা। রোদ্দুরে ঝিকিয়েছে, জ্যোৎস্নায় পুড়েছে, বৃষ্টিতে ধুয়েছে। ভোঁ দিয়ে দূরপাল্লার এক্সপ্রেস উড়ে গিয়েছে মাঝে-মাঝে। কিন্তু ঢিমে তেতালায় মৃদু কাঁপন তুলে চেনা শব্দ গড়িয়ে আসেনি।শেষমেশ ফের— রেল কাম ঝমাঝম! কলকাতা টু কেষ্টনগর— কল্যাণী, রানাঘাট, শান্তিপুর, নবদ্বীপ, গেদে, পলাশি।মঙ্গলবার সাতসকালেই কৃষ্ণনগর স্টেশনে ছুটে এসেছিলেন নতুন কালীপুরের বাসিন্দা উত্তম সাহা। টিকিট কাউন্টারের পাশে তাঁর প্রায় তিরিশ বছরের ঝালমুড়ির স্টল। লকডাউনের দিন থেকে ট্রেন বন্ধ, স্টলও বন্ধ। ভ্যানে করে ফল নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরেছেন এত দিন। বুধবার থেকে ট্রেন চলার খবর পাওয়ার পর থেকে তাঁর পরিবারে কার্যত উৎসবের মেজাজ। দীর্ঘ দিন বন্ধ থাকা স্টল ঝাড়পোঁছ করতে করতে ফাঁকা কাচের বয়ামটাকে বাচ্চার মতো বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে থাকেন কিছুক্ষণ। তার পর তার গায়ে পরম মমতায় ন্যাকড়া বোলাতে বোলাতে বলেন, “অনেক দিন পর স্টেশনে এসে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলাম।”
এতগুলো দিন খাঁ-খাঁ করত স্টেশন চত্বর। জনমানবহীন স্টেশনে দু’চার জন ইতিউতি বসে থাকত আর কয়েকটি রেলপুলিশ। সেই স্টেশনের ঘুম যেন আচমকা ভাঙিয়ে দিয়েছে কেউ। স্টলগুলোতে আবার ব্যস্ততা ফিরে আসছে। তবে তার মাঝেও রয়েছে ধন্দ, রেলপুলিশ দোকন খুলে বসতে দেবে তো? লাঠি উঁচিয়ে ঝাঁপ ব্ধ করে দেবে না তো? কোভিড সুরক্ষা নিয়েও থাকছে প্রশ্ন। অফিস টাইমে পারস্পরিক দূরত্ব রক্ষা হবে তো? কী ভাবে ভিড় সামাল দেবে পুলিশ ও রেল? গোলমাল বেধে যাবে না তো? পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য রেলপুলিশ, আরপিএফ এবং জেলা পুলিশের মধ্যে একাধিকবার বৈঠক হয়েছে। বৈঠক করেছেন জেলা প্রশাসনের কর্তারাও।
আপাতত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যেখানে সম্ভব সেখানে স্টেশনে ঢোকা ও বেরনোর জন্য আলাদা গেট ব্যবহার করা হবে। যেমন কৃষ্ণনগর স্টেশন থেকে বেরনোর জন্য প্রধান গেট ব্যবহার করা হবে। কারণ এটি বেশি চওড়া, ট্রেন থামার পরে এক সঙ্গে অনেক মানুষ বেরবেন বলেই বড় গেটটিকে নির্দিষ্ট করা হয়েছে। টিকিট কাউন্টারের সামনে ছোট গেট স্টেশনে ঢোকার জন্য ব্যবহার করা হবে। সেখানে জেলা প্রশাসনের কর্মীরা থাকবেন থার্মাল গান নিয়ে। প্রতিটি যাত্রীর শরীরের তাপমাত্রা পরীক্ষা করা হবে। কারও জ্বর থাকলে তাঁকে সঙ্গে সঙ্গে আলাদা করে নিয়ে যাওয়া হবে। স্টেশন চত্বরে থাকবে অ্যাম্বুল্যান্স। তাতে চাপিয়ে অসুস্থ ব্যক্তিকে নিকটবর্তী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হবে।
রেল সূত্রে জানানো হয়েছে, সবাইকেই টিকিট দেওয়া হবে এবং টিকিটধারী কাউকেই ট্রেনে উঠতে বাধা দেওয়া হবে না। তবে মুখে মাস্ক না থাকলে স্টেশনে ঢুকতে দেওয়া হবে না। পারস্পরিক দূরত্ববিধি রক্ষা হচ্ছে কি না সেটা দেখার জন্য স্টেশনে থাকবেন পর্যাপ্ত সংখ্যক রেলপুলিশ কর্মী এবং আরপিএফ জওয়ান। স্টেশনের বাইরে ভিড় ঠেকাবেন জেলা পুলিশের সিভিক ভলান্টিয়ারেরা। স্বাভাবিক সময়ে কৃষ্ণনগর স্টেশনে ৩৮ জোড়া ট্রেন চলত। আজ থেকে চলবে ১৬ জোড়া। শিয়ালদহ এবং রানাঘাট থেকে লালগোলা পর্যন্ত ইএমইউ ট্রেনও চলবে। সব টিকিট কাউন্টারই খোলা থাকবে। প্রতিটি ট্রেন ছাড়ার আগে সংক্রমণমুক্ত করা হবে। কৃষ্ণনগর স্টেশন ম্যানেজার স্বপনকুমার মণ্ডল বলছেন, “আমরা সমস্ত নির্দেশিকা বাস্তবায়িত করার চেষ্টা করব। আশা করছি, কোনএ সমস্যা হবে না।” কৃষ্ণনগর জিআরপি থানার ওসি গৌতম দাশগুপ্ত বলেন, “সুরক্ষা বিধি যাতে সর্বতো ভাবে রক্ষা হয় সেটা আমরা দেখব। আমাদের সকলেই স্টেশনে থাকবেন। যাত্রীদের কোনও সমস্যা হবে না।”
রানাঘাট বা চাকদহের মতো বিভিন্ন গুরুত্বপুর্ণ স্টেশনেও প্ল্যাটফর্মে যাত্রীদের ঠোকা-বেরনোর পথ নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। নবদ্বীপ ধাম স্টেশনও প্রস্তুত। ট্রেন চলাচলের জন্য যাবতীয় ব্যবস্থা ইতিমধ্যেই নেওয়া সম্পূর্ণ হয়েছে। এমনিতেই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন বলে নবদ্বীপ স্টেশনের সুনাম চিরকালের। স্টেশন ম্যানেজার প্রশান্ত মণ্ডল বলেন, “আমরা সব দিক থেকে তৈরি। তবে স্টেশনে যাত্রীদের ঢোকার সময়ে থার্মাল চেকিংয়ের মতো কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি এখনও পর্যন্ত।” স্টেশনে প্রবেশের মূল পথ ছাড়া অন্য দিকগুলি ঘেরার ব্যবস্থা হচ্ছে। হাওড়া-কাটোয়া সুবার্বন প্যাসেঞ্জার অ্যাসোসিয়েশনের নবদ্বীপ শাখার তরফে বুধবার ভোর থেকে স্টেশনের প্রবেশ পথে যাত্রীদের মাস্ক দেওয়া এবং স্টেশন এলাকা স্যানিটাইজ় করা হবে বলে জানানো হয়েছে।
তবে এ সবের মধ্যে হকাররা ট্রেনে ওঠতে পারবেন কি না বা স্টেশন চত্বরে স্টল খোলা থাকবে কি না তা নিয়ে মুখে কুলুপ এঁটেছেন স্টেশন ম্যানেজারেরা। প্রাথমিক ভাবে পূর্ব রেল সূত্রে জানানো হয়েছে, হকারদের এখনওই অনুমতি দেওয়া হবে না। তবে তাঁরা জোরাজুরি করলে কী হবে তা স্পষ্ট নয়। ইস্টার্ন রেল শিয়ালদহ ডিভিশন হকার ইউনিয়নের কৃষ্ণনগর শাখার সম্পাদক তপন কুণ্ডু বলেন, “এতগুলো মাস কোনও মতে টিকে আছেন হকারেরা। ট্রেন চললে তো তাঁরা কাজ করবেনই। কেউ আটকাতে পারবে না।” পুর্বরেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক নিখিল চক্রবর্তী বলেন, “আপাতত ব্যস্ত সময়ে শতকরা ৮৪ ভাগ ট্রেন চালানো হবে। পরিস্থিতি বুঝে পদক্ষেপ করা হবে।”