পাচার রুখতে পাটে কোপ, উদ্বেগে চাষিরা

দেশের নিরাপত্তার জন্য কি তবে ভাতের থালায় টান পড়বে? পুজোর মুখে পাটচাষ বন্ধ করার কথা ওঠায় প্রশ্নটা ফের উঠতে শুরু করেছে নদিয়া-মুর্শিদাবাদের সীমান্তের গ্রামে। সম্প্রতি সীমান্তে পাচার রুখতে কেন্দ্র সরকারের কাছে পাটচাষ বন্ধের আর্জি জানিয়েছে সীমান্তরক্ষী বাহিনী।

Advertisement

গৌরব বিশ্বাস

কলকাতা শেষ আপডেট: ১১ অগস্ট ২০১৫ ০১:২০
Share:

ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের কাঁটাতারের পাশে পাটের খেত। ছবি: কল্লোল প্রামাণিক।

দেশের নিরাপত্তার জন্য কি তবে ভাতের থালায় টান পড়বে? পুজোর মুখে পাটচাষ বন্ধ করার কথা ওঠায় প্রশ্নটা ফের উঠতে শুরু করেছে নদিয়া-মুর্শিদাবাদের সীমান্তের গ্রামে।

Advertisement

সম্প্রতি সীমান্তে পাচার রুখতে কেন্দ্র সরকারের কাছে পাটচাষ বন্ধের আর্জি জানিয়েছে সীমান্তরক্ষী বাহিনী। তাঁদের দাবি, সীমান্তের দু’পাশে প্রায় মানুষ-সমান লম্বা পাটগাছের আড়ালকে কাজে লাগিয়ে গরু পাচার করছে দুষ্কৃতীরা। পাটখেতের ওপারে কী ঘটছে তা দূর থেকে দেখে বোঝা যায় না। বিএসএফ চাইছে, কেন্দ্র বিষয়টি রাজ্যের সঙ্গে আলোচনা করে পাটের বিকল্প চাষের ব্যবস্থা করুক।

সীমান্তের চাষিদের প্রশ্ন, পাচারের জন্য শুধু পাটকেই কেন দায়ী করা হচ্ছে? পাট চাষ তো বছরে তিন থেকে চার মাসের ব্যাপার। তাহলে বাকি সময়টা কী ভাবে পাচার চলে?

Advertisement

মুর্শিদাবাদের শেখপাড়ার জহিরুদ্দিন শেখ বলছেন, ‘‘এখন পাটচাষ বন্ধ করবে। তারপর বলবে কলাও লম্বা ফসল। সেটাও বন্ধ করে দিতে হবে। পাচার রুখতে গিয়ে চাষি মার খাচ্ছে।’’ কাতলামারি গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান কংগ্রেসের মহম্মদ মোল্লা বলেন, ‘‘বিএসএফ যদি জিরো পয়েন্টে পাহারা দেয় তাহলেই তো সমস্যা মিটে যায়।’’ বিএসএফ-এর গাফিলতির কথাই বলছেন মুর্শিদাবাদের সাংসদ সিপিএমের বদরুদ্দোজা খান। তাঁর কথায়, ‘‘ভূত আসলে সর্ষের মধ্যেই। চাষিদের ভাতে না মেরে বিএসএফ বরং সেই ভূত তাড়ানোর ব্যবস্থা করুক।’’

নদিয়া ও মুর্শিদাবাদের অন্যতম প্রধান অর্থকরী ফসল পাট। এই পাটের উপরেই নির্ভর করে সীমান্তের অর্থনীতি। ফলে যখনই সীমান্তে পাটচাষ বন্ধের কথা উঠেছে তখনই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন সীমান্তের চাষিরা। করিমপুর ১ পঞ্চায়েত সমিতির প্রাক্তন কর্মাধ্যক্ষ শঙ্কর মণ্ডল জানান, কেন্দ্রের কাছে আর্জি এবার বিএসএফ প্রথম জানালেও, গত দশ বছরে সীমান্তের বহু এলাকায় বিএসএফ ফতোয়া দিয়ে পাটচাষ বন্ধ করতে চেয়েছিল। চাষিরা প্রতিবাদ করে সে ফতোয়া রুখে দিয়েছে।

কিন্তু বিকল্প চাষে আপত্তি কেন?

চাষিদের বক্তব্য, পাট ছাড়া আর কোনও ফসল সীমান্ত-লাগোয়ে জমি থেকে ঘরে তুলে আনতেই পারবেন না তাঁরা। ‘‘বাংলাদেশের দুষ্কৃতীদের অত্যাচারে গরু-বাছুরের জন্য জমির ঘাসটুকুও খেত থেকে ঘরে আনতে পারি না।’’ পাটগাছ যেহেতু কেটে নিয়ে যাওয়া সহজ নয়, আর কাটার পরেও তা থেকে পাট তৈরির দীর্ঘ প্রক্রিয়া থাকে, সেই জন্য তা চুরি হয় কম। তাই চাষিদের চিন্তা, পাট ছাড়া অন্য কোনও চাষ করলে সেই ফসল চুরি আটকাবেন কী করে? নদিয়ার কাছাড়িপাড়ার চাষি নীরেন সরকার, ফটিক সরকারদের কথায়, ‘‘পাটের বিকল্প চাষ আমরাও জানি। কিন্তু তিল, বাদাম, তিসি কি ঘরে তুলতে পারব?’’

সীমান্তে চাষ করতে হয় প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে। নাসিরেরপাড়া সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়ার ওপারে প্রায় তিন হাজার বিঘে ভারতীয় জমি রয়েছে। বিএসএফের কাছে ভোটার কার্ড জমা দিয়ে সেই জমিতে চাষ করেন চাষিরা। ২০০৫ সালে সেই জমিতে চাষ করতে গিয়ে বাংলাদেশের দুষ্কৃতীদের হাতে খুন হ’ন ওই এলাকার তিন চাষি। দুষ্কৃতীদের হাতে কতজন যে জখম হয়েছেন তার হিসেব নেই। গ্রামবাসীদের লাগাতার দাবির চাপে বছর কয়েক আগে চরের ওই মাঠে তৈরি হয় উদয় ক্যাম্প।

নাসিরেরপাড়ার চাষি সুবোধ সরকার বলছেন, ‘‘ক্যাম্প হওয়ার পর থেকে খুন-জখম আর হয় না। কিন্তু ফসল চুরি এখনও হয়। বাংলাদেশের দুষ্কৃতীদের অত্যাচারে ওই তিন হাজার বিঘে জমির মধ্যে এখনও প্রায় সাত-আটশো বিঘে জমি অনাবাদি হয়েই পড়ে আছে।’’ তাঁর প্রস্তাব, তাঁরা সীমান্তের দু’দিকে দেড়শো মিটার এলাকা ফাঁকা রেখে পাটচাষ করতে পারেন। কিন্ত পাটচাষ বন্ধ করা অসম্ভব।

বিএসএফের ১৩০ ব্যাটেলিয়নের এক কর্তা অবশ্য বলছেন, ‘‘পাটের সুযোগ নিয়ে গরু পাচার চলছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বহু বার বিষয়টি জানিয়েছি। তাই ডিজি কেন্দ্রের কাছে আবেদন করেছেন। এখন সরকার যেমন সিদ্ধান্ত নেবে তেমনটাই হবে।’’

(সহ প্রতিবেদন: সুজাউদ্দিন)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement