হরনগরে বাঁধ ভেঙে ঢুকছে জলঙ্গির জল। ডান দিকে, মায়াপুরে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। —নিজস্ব চিত্র।
ইস্কনের নাট মন্দিরের সামনে হাঁটু জল। একটু এগিয়ে দু’ধাপ নীচে নামতেই জল একেবারে কোমর ছুঁইছুঁই। সেখানে দাঁড়ালে চোখে পড়বে ভরা গঙ্গার গেরুয়া জল। বিপদসীমার উপর দিয়ে বইতে থাকা যে নদীর জল ঘণ্টায় ঘণ্টায় বেড়েই চলেছে। নদীর পশ্চিম পাড়, নবদ্বীপে তখন জলমগ্ন মানুষের কলরব। পাঠকীর্তন শোনার
বদলে অনেকেই ব্যস্ত জায়গা ভাগাভাগিতে। ছুটির দিন রবিবার, নবদ্বীপ ব্লক এবং পুর এলাকায় এমনই সব ছবি চোখে পড়ল।
এক দিকে নাগাড়ে বৃষ্টি তো অন্য দিকে ক্রমাগত বেড়ে চলা নদীর জল। দু’য়ের জেরে নদিয়া-মুর্শিদাবাদের জলমগ্ন এলাকার পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। শনিবার নদিয়ায় গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল ৩৪.২০ মিলিমিটার। অন্য দিকে স্বরূপগঞ্জের কাছে গঙ্গা বইছে চরম বিপদসীমা ৯.০৫ সেন্টিমিটার ছাপিয়ে অনেক উপর দিয়ে। রবিবার দুপুর দু’টোর সময় জলস্তর ছিল ৯.৬১ সেন্টিমিটার। ঘণ্টায় ঘণ্টায় সেই জলস্তর বাড়ছে। কৃষি দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে শুধু নবদ্বীপেই এখনও পর্যন্ত প্রায় সাড়ে তিন হাজার হেক্টর জমির ফসল জলের তলায় চলে গিয়েছে।
নবদ্বীপ পঞ্চায়েত সমিতি সূত্রে খবর ব্লকের প্রায় সব ক’টি পঞ্চায়েতেই গঙ্গার জলে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। প্রতিদিনই অবস্থার অবনতি হচ্ছে। পঞ্চায়েতগুলির প্রতিটি স্কুল, এসএসকে, এমএসকে কার্যত ত্রাণ শিবিরে পরিণত হয়েছে। দশ হাজারের বেশি মানুষ ওই সব শিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন। ত্রিপলের জন্য হাহাকার শুরু হয়েছে চারদিকে। বিভিন্ন শিবিরে আশ্রয় নেওয়া মানুষের মধ্যে এ নিয়ে ক্ষোভ বাড়ছে। গ্রামের মানুষ দুর্ভোগ বেড়েছে গবাদি পশু নিয়ে। ত্রিপলের অভাবে এলাকার উঁচু জায়গায় এই সব গবাদি পশুর অস্থায়ী বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে না পেরে দিশাহারা বহু মানুষ। গ্রামবাসীদের অনেকের আশঙ্কা, এ ভাবে চলতে থাকলে রোগাক্রান্ত হয়ে গবাদি পশুগুলির মৃত্যু হবে।
চাষজমি জলের তলায় চলে যাওয়ায় গবাদি পশুই এখন গ্রামের চাষিদের ভরসার জায়গা। নবদ্বীপ পঞ্চায়েত সমিতির সহ সভাপতি তাপস ঘোষ বলেন, “রোজ নতুন নতুন এলাকা জলে ভাসছে। দুর্ভোগের শিকার গবাদি পশুরাও। ত্রিপলের দরকার সবচেয়ে বেশি। জেলা প্রশাসনের কাছে আড়াই হাজার ত্রিপল চেয়ে মিলেছে চারশো। ত্রানের জন্য মিলেছে দশ কুইন্ট্যাল চাল।”
নবদ্বীপ শহরের ২৪টি ওয়ার্ড জলমগ্ন। এত দিন ওয়ার্ডগুলি বৃষ্টির জলে ডুবে থাকলেও শুক্রবার থেকে গঙ্গার জল শহরের বিভিন্ন এলাকায় ঢুকতে শুরু করেছে। কিছু ওয়ার্ড সম্পূর্ণ জলের তলায়। ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে নবদ্বীপ শহরের পরিধি। পুরপ্রধান বিমানকৃষ্ণ সাহা জানিয়েছে এই মুহূর্তে নবদ্বীপে মোট ৮০টি ত্রাণ শিবিরে প্রায় ৪২ হাজার মানুষ রয়েছেন। শহরের সব কটি স্কুল ছাড়াও বড় মঠ মন্দিরের অতিথিশালা, নাটমন্দিরের বহু মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। খোদ চৈতন্য জন্মস্থান আশ্রম, মহাপ্রভু বাড়ি সর্বত্রই ঠাঁই নিয়েছেন বন্যা দুর্গত মানুষ।
পাশের জেলা মুর্শিদাবাদেও বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা কান্দি মহকুমা এবং বহরমপুরের সাটুইয়ের। দ্বারকা ও বাবলা নদীর জলস্তর বিপদসীমার উপর দিয়ে বইছে। এ দিকে ভাগীরথীও বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় বাবলা নদীর জল ভাগীরথীতে না পড়ে উল্টো দিকে বইতে শুরু করেছে। তার জেরে কান্দির হিজল, আন্দুলিয়া, মহালন্দি ২ গ্রাম পঞ্চায়েতের পাশাপাশি ভরতপুর ১ ব্লকের অবস্থার অবনতি হয়েছে। ভরতপুর ১ ব্লকের গড্ডা, আমলাই, আলুগ্রাম, বিন্দারপুর গ্রাম পঞ্চায়েত আগেই জলমগ্ন হয়েছে। বাবলার জলে ওই ব্লকের সিজগ্রাম গ্রাম পঞ্চায়েতের পল্লীশ্রী, গোপালপুর, করিদ্ধার মতো বহু গ্রামে নতুন করে জল ঢুকেছে। তিলপাড়া, বৈধরা ও দেওচা জলাধার থেকে দফায় দফায় জল ছাড়ায় ময়ূরাক্ষী, দ্বারকা ও ব্রাম্ভণী নদীতে জল বেড়েছে।
একই ভাবে খড়গ্রামের দ্বারকা ও ব্রাম্ভণী নদীর জল বিপদ সীমার উপর দিয়ে বইছে। কান্দি-সালার রাজ্য সড়কের উপরে আঙ্গারপুর ও সালার থানা এলাকার রাইগ্রামের কাছে রাজ্য সড়কে জল উঠে যাওয়ায় ওই এলাকায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে নৌকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বড়ঞা ব্লকের ময়ূরাক্ষী নদীর উপরে মালিয়ান্দি গ্রাম সংলগ্ন এলাকায় নদীবাঁধের অবস্থার অবনতি হওয়ায় স্থানীয় পঞ্চায়েত ও সেচ দফতর যুদ্ধকালীন তৎপরতায় বালির বস্তা দিয়ে বাঁধ মেরামত শুরু করেছে।
কুঁয়ে নদীর জলস্তর হু হু করে বাড়তে থাকায় ফের জলবন্দি হয়েছে সোনাভারুই, বৈদ্যনাথপুর, জাওহাড়ি, ভড়ঞার মতো গ্রাম। হলদিয়া-ফারাক্কা বাদশাহী সড়কের উপরেও ওই নদীর জল উঠতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রশাসনের। কান্দি মহকুমায় রবিবার আরও পাঁচটি ত্রাণ শিবির খোলা হয়েছে। এ নিয়ে ত্রাণ শিবিরের সংখ্যা দাঁড়াল ৩৫। কান্দির মহকুমাশাসক বিজিন কৃষ্ণ জানান, পরিস্থিতির উপরে নজর রাখা হচ্ছে। সর্বত্র ত্রিপল, চাল, জামা কাপড় সরবরাহ করা হচ্ছে।
এ দিকে, শনিবার পর্যন্ত নদিয়া-মুর্শিদাবাদে মৃতের সংখ্যা ছিল পাঁচ। রবিবার আরও দু’জনের মৃত্যু হয়েছে। এ দিন জলের তোড়ে ভেসে গিয়ে মৃত্যু হয়েছে বছর পঁয়ষট্টির রানি বেওয়ার। বাড়ি মুর্শিদাবাদের বড়ঞায় আনন্দনগরে। স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, এ দিন গ্রামের রাস্তা ধরে বৈদ্যনাথপুর মোড়ের দিকে যাচ্ছিলেন রানি। হঠাৎই জলের স্রোতে ভেসে যান তিনি। স্থানীয় বাসিন্দারা ওই বৃদ্ধাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করান। কিন্তু তাঁকে বাঁচানো যায়নি। ফরাক্কা থানার আধোঁয়া গ্রামে মাটির দেওয়াল চাপা পড়ে মৃত্যু হয়েছে দেড় বছরের সুহিনা খাতুনের। বেশ কিছু দিন ধরেই জলে ডুবে ছিল তাদের মাটির বাড়ি। শনিবার রাতে সেই দেওয়াল ধসে যায়। সেই সময় মা সাজো বিবির পাশে ঘুমিয়ে ছিল তিন ছেলেমেয়ে। দুর্ঘটনার জেরে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় দেড় বছরের সুহিনার। মা ও অন্য দুই শিশুকে প্রাথমিক চিকিৎসার পরে বেনিয়াগ্রাম স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়।