মহম্মদ ইজাজ ওরফে ইজাজ আহমেদ।—ফাইল চিত্র।
ত্রিশালের কায়দাতেই জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি) জঙ্গি গোষ্ঠীর শীর্ষ নেতা জহিদুল ইসলাম ওরফে কওসারকে জেলমুক্ত করতে পরিকল্পনা করেছিল মহম্মদ ইজাজ। গয়া থেকে ধৃত জেএমবি-র ভারতীয় শাখার প্রধান বীরভূমের ইজাজকে জেরা করে এমনটাই জানতে পেরেছেন এসটিএফের গোয়েন্দারা।
গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন, ২০১৪-র অক্টোবরে বর্ধমানের খাগড়াগড়ে দুর্ঘটনাজনিত বিস্ফোরণের কারণে বীরভূম, বর্ধমান এবং মুর্শিদাবাদে জেএমবি-র ছড়িয়ে থাকা একের পর এক মডিউল এবং শীর্ষ নেতাদের নাম সামনে এলেও, ইজাজ নিজেকে আড়ালে রাখতে পেরেছিল। যেমনটা পেরেছিল ওই সংগঠনের আরও এক শীর্ষ নেতা সালাউদ্দিন সালেহিন।
খাগড়াগড় বিস্ফোরণের প্রায় পাঁচ বছর পর গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন, ওই সময় থেকেই ইজাজ ছিল সংগঠনের নীতি নির্ধারক মজলিশ-এ-সুরার সদস্য এবং শীর্ষ নেতাদের আস্থাভাজন। বয়স ৩০-এর কোঠাতে হলেও সাংগঠিক দক্ষতার কারণে নতুন সদস্য নিয়োগ এবং তহবিল গড়ার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ইজাজকে।
আরও পড়ুন: পাওনা টাকা চাইতেই কাটারি তুলে মহিলাকে খুনের হুমকি, অভিযুক্ত প্রযোজক
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গিয়েছে, বীরভূমের পাড়ুইয়ের অবিনাশপুরের বাসিন্দা ইজাজ স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে। এর পরই ভর্তি হয় স্থানীয় একটি মাদ্রাসায়। সেখান থেকে ধর্মীয় পাঠ শেষ করে সে শিক্ষক হিসাবে মঙ্গলকোটের কুলসোনা গ্রামের একটি মাদ্রাসায় যোগ দেয়। সেখানেই সে জেএমবি-র সদস্যদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয় এবং ধীরে ধীরে ২০১০ সাল নাগাদ পুরোপুরি ওই সংগঠনে যোগ দেয়।
তদন্তকারীদের দাবি, ২০১১ সালে সে বিয়েও করে। তত দিনে মঙ্গলকোটের শিমুলিয়া মাদ্রাসায় সে শিক্ষক হিসাবে যোগ দিয়েছে। সেখানে কদর গা়জি, মৌলানা ইউসুফের সঙ্গেই জেএমবি সদস্যদের জেহাদি প্রশিক্ষণও দেয় সে।
গোয়েন্দাদের দাবি, শিমুলিয়া মাদ্রাসার সঙ্গেই ইজাজ সক্রিয় ছিল মুর্শিদাবাদে মুকিমনগর মাদ্রাসাতেও। সেখানে সংগঠনের অন্যতম শীর্ষ নেতা রহমতউল্লা বা সাজিদকে প্রশিক্ষণ এবং তহবিল গড়ার কাজে সহায়তা করে সে। এর মধ্যেই ২০১৪-র ২৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের মৈমনসিংহ জেলার ত্রিশালে, জেল থেকে আদালতে মৃত্যু দণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত তিন জেএমবি জঙ্গিকে নিয়ে যাওয়ার পথে হামলা হয় পুলিশের গাড়ির উপর। পুলিশকে হত্যা করে ছিনিয়ে নেওয়া হয় শীর্ষ জেএমবি নেতা সানু, রাকিব এবং বোমা মিজানকে। ঘটনার পরের দিন রাকিব পুলিশের গুলিতে মারা গেলেও গায়েব হয়ে যায় বাকি দু’জন।
আরও পড়ুন: প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর বিরুদ্ধে যৌন নিগ্রহের অভিযোগ, তিন দিন ধরে খোঁজ নেই তরুণীর!
কয়েক মাস পরে খাগড়াগড় বিস্ফোরণের তদন্ত করতে গিয়ে সামনে আসে কওসরের নাম। জানা যায়, ত্রিশালে পুলিশভ্যান থেকে পালানো ‘বোমা মিজান’ই খাগড়াগড়ের কওসর। ওই তদন্তে বাংলাদেশ পুলিশ জানতে পেরেছিল, পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান-মুর্শিদাবাদ এবং বীরভূমে ডেরা বেঁধে থাকা জেএমবি জঙ্গিরাই ওই হামলার ছক কষেছিল। বাংলাদেশ পুলিশের তদন্তে উঠে এসেছিল কয়েক জন ভারতীয় জেএমবি জঙ্গির নাম যারা সক্রিয় ভাবে যুক্ত ছিল ওই হামলায়।
এসটিএফের এক শীর্ষ কর্তা ইঙ্গিত দেন, ‘‘ত্রিশালের ওই হামলার ছক পুরোটাই জানত ইজাজ। তবে ওই ছকে তার কী ভূমিকা ছিল তা এখনও স্পষ্ট নয়।” তদন্তকারীদের দাবি, খাগড়াগড় পরবর্তী সময়ে গ্রেফতারি এড়াতে দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন জায়গায় কওসর এবং কদর গাজির সঙ্গেই গা-ঢাকা দিয়েছিল সে। কিন্তু সেখানে সংগঠন পুনর্গঠনের সময়ে কওসরের সঙ্গে আদর্শগত বিরোধ তৈরি হয় ইজাজের। তদন্তকারীরা জানতে পেরেছেন, ত্রিশাল হামলায় মুক্তি পেয়ে সালাউদ্দিন ওরফে সানু আশ্রয় নেয় ভারতে। তখন থেকেই সে ইজাজের ঘনিষ্ঠ। অন্য দিকে কওসরের তৈরি ধূলিয়ান মডিউলের (যা বুদ্ধগয়ায় বিস্ফোরণের জন্য তৈরি করা হয়েছিল) একের পর এক সদস্য ধরা পড়ার পর কওসরের সঙ্গে বিরোধের জেরে এ রাজ্যে ফিরে আসে ইজাজ। বীরভূমেরই কুস্টিকুড়ি গ্রামে একটি ছোট্ট অ-নথিভুক্ত মাদ্রাসায় ফের শিক্ষকতা শুরু করে সে।
তার মধ্যেই ফের তার যোগাযোগ হয় সালাউদ্দিনের সঙ্গে। ২০১৮-র অগস্ট মাসে কওসর বেঙ্গালুরু থেকে ধরা পড়ার পর ত্রিশালের কায়দাতেই পুলিশ ভ্যানে হামলার ছক করে জেএমবি জঙ্গিরা। কিন্তু হামলার জন্য যে বিশেষ দলটি তৈরি করা হয়েছিল, সেই দলটিকে হামলার আগেই ধরে ফেলেন কলকাতা পুলিশের স্পেশ্যাল টাস্ক ফোর্সের গোয়েন্দারা। তাদের জেরা করেই জানা যায় হামলার ছক এবং আরও জানা যায়, হামলার মূল ছক করেছিল ইজাজ। এর আগে ইজাজ সম্পর্কে স্পষ্ট কোনও তথ্যও ছিল না গোয়েন্দাদের কাছে।
মঙ্গলবার ইজাজকে গয়া থেকে কলকাতায় এনে ব্যাঙ্কশাল আদালতে তোলা হলে বিচারক তাকে ১৪ দিনের পুলিশি হেফাজতের নির্দেশ দিয়েছেন।