নবান্ন।
কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রার্থীদের ‘পুলিশ ভেরিফিকেশন’ এবং ‘মেডিক্যাল টেস্ট’-এর যে-সব শর্ত নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে, তার সবই বাতিল করা হবে বলে বৃহস্পতিবার নবান্ন থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
প্রশাসনিক সূত্রের খবর, পুরো বিষয়টি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নজরে আসার পরে নবান্নের শীর্ষ মহল থেকে তাঁকে বলা হয়, এ রাজ্যে সরকারি চাকরি করতে গেলে বিভিন্ন শর্ত পূরণ করতেই হয়। বছরের পর বছর এমনটাই চলে আসছে। কেউ বিষয়গুলি আর সে-ভাবে খুঁটিয়ে-খতিয়ে দেখেনি। তার পরেই জানিয়ে দেওয়া হয়, সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে নিয়োগের এই সব শর্ত বাতিল করতে হবে। কারণ, এই ধরনের বিষয় অভিপ্রেত নয়। ভবিষ্যতেও যাতে এমন পরিস্থিতির উদ্ভব না-হয়, তা নিশ্চিত করা হচ্ছে।
২০১৭ সালের উচ্চশিক্ষা আইন অনুযায়ী কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রার্থীদের ‘পুলিশ ভেরিফিকেশন’ বা পুলিশ দিয়ে প্রার্থীর বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া এবং মেডিক্যাল টেস্ট বা স্বাস্থ্যপরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সেই বিষয়ে প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তি নিয়ে শিক্ষক-শিক্ষিকারা আপত্তি তোলেন। তাঁরা জানিয়ে দেন, এই বিজ্ঞপ্তি তাঁরা বাস্তবায়িত হতে দেবেন না। বুধবার পুলিশি যাচাইয়ের ফর্মের বিভিন্ন অংশ নিয়ে আপত্তি জানানো হয়। বলা হয়, এই ফর্মে যা রয়েছে, তা সিএএ, এনআরসি, এনপিআর চালু করারই পন্থা। বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্যপরীক্ষা নিয়েও বিতর্ক শুরু হয়। স্বাস্থ্যপরীক্ষায় বিভিন্ন বিষয়ের সঙ্গে জানতে চাওয়া হয়েছে, মহিলা প্রার্থীদের জরায়ু ও ডিম্বাশয়ের অবস্থা কী। পুরুষদের ক্ষেত্রে হাইড্রোসিল-হার্নিয়া আছে কি না, তা-ও জানতে চাওয়া হয়েছে। এ-সবই অত্যন্ত অপমানজনক বলে মনে করছেন শিক্ষক-শিক্ষিকাদের একাংশ। নবান্নের খবর, এই সব শর্তই বাতিল হবে।
শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বিধানসভায় ‘দ্য ওয়েস্টবেঙ্গল ইউনিভার্সিটি অ্যান্ড কলেজ (প্রশাসন ও নিয়ন্ত্রণ) বিল, ২০১৭’ পেশ করেছিলেন ২০১৭-র ফেব্রুয়ারিতে। তাতে অন্য কয়েকটি বিতর্কিত বিষয়ের সঙ্গে পুলিশি যাচাই এবং স্বাস্থ্যপরীক্ষাও ছিল। বিরোধী সব শিক্ষক সংগঠনই সক্রিয় ভাবে সেই বিলের বিরোধিতায় নামে। বিজ্ঞপ্তির কিছু বিষয় নিয়ে আবার বিতর্ক শুরু হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, পুলিশি যাচাই ও স্বাস্থ্যপরীক্ষা হবেই। সেই সঙ্গে ‘পার্সোনাল অ্যান্টিসিডেন্টস’ বা প্রার্থীর পূর্বপরিচয় খতিয়ে দেখবে পুলিশ। এর সঙ্গে রয়েছে, শিক্ষকপদের আবেদনকারী যদি আদতে পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল বা অন্য দেশের বাসিন্দা হন, তা হলে সেই দেশে তাঁদের ঠিকানা কী ছিল, তা জানাতে হবে। ১০ নম্বর পয়েন্টে জানতে চাওয়া হচ্ছে, প্রার্থী কোন ধর্মাবলম্বী। তবে এগুলো আর থাকবে না বলে জানিয়েছে নবান্ন।
স্বাস্থ্যপরীক্ষায় জরায়ু, ডিম্বাশয়ের অবস্থা জানতে চাওয়ায় বিতর্ক শুরু হয়। প্রশাসনিক সূত্রের খবর, সরকারি চাকরিতে এগুলো জানতে চাওয়া হয় না। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি (কুটা) সভানেত্রী ঈশিতা মুখোপাধ্যায়ের মন্তব্য, সরকার চাকরিপ্রার্থীদের শরীরের উপরে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে চাইছে। এই নির্দেশ গ্রহণযোগ্য নয়। তাঁর মতে, এটা রূপান্তরকামীদের চাকরি না-দেওয়ারও পরিকল্পনা হতে পারে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির (জুটা) সহ-সভানেত্রী নন্দিনী মুখোপাধ্যায়ের জানান, এটা চরম অসম্মানজনক। তবে শাসক দলের কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সংগঠন ওয়েবকুপা-র সভানেত্রী কৃষ্ণকলি বসুর মতে, অনেক কলেজে খেলাধুলো, শারীরশিক্ষা থাকে। এ-সব ক্ষেত্রে কারও জরায়ু, ডিম্বাশয়ে কোনও সমস্যার কথা কলেজ-কর্তৃপক্ষের জানা থাকলে কিছু কিছু কাজ করতে দেওয়া হবে না। হয়তো সেই জন্যই এমন নির্দেশ। এই ধরনের সব শর্তই বাদ দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছে নবান্ন।
জুটা-র সাধারণ সম্পাদক পার্থপ্রতিম রায় এক বিবৃতিতে এই সব পরীক্ষা বাতিলের দাবি তুলেছেন। তাঁর বক্তব্য, সরকারের এই হস্তক্ষেপ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধিকার খর্ব করবে। কুটা-র সাধারণ সম্পাদক পার্থিব বসু উচ্চশিক্ষার স্বাধিকার খর্ব করার চেষ্টার বিরুদ্ধে এক হওয়ার ডাক দিয়েছেন।