অভিযুক্তর শাস্তির দাবিতে তমলুক জেলা আদালতের সামনে বিক্ষোভ ।
বুধবারের দুপুর। গড়কিল্লার পাশের দক্ষিণ উসুদপুর গ্রামে মনসা মন্দিরে তখন বসে রয়েছেন কয়েকজন। জিজ্ঞাসা করাতে উত্তর এল, তন্ত্রসাধক সুধাংশুশেখর মুড়ার সাক্ষাৎপ্রার্থী তাঁরা।
রামপদর কথা এখন গ্রামের মানুষের মুখে মুখে। তারপরও কেন এমন তন্ত্র নির্ভরতা? উত্তর দেননি অপেক্ষমান ভক্ত। তবে তন্ত্রবিদ্যার চর্চার সঙ্গে জড়িত সুধাংশুশেখর মুড়ার দাবি, ‘‘তন্ত্র সাধনায় বলি দেওয়ার বিষয় নেই। ওই তরুণীকে খুন করে নিজেকে আড়াল করার জন্য রামপদ এ কথা বলছে।’’ আর সেখানেই আবার প্রশ্ন উঠছে, তাহলে কি তন্ত্রসাধনার পিছনে এই খুনের অন্য কারণ রয়েছে?
গত শনিবার তমলুকের গড়কিল্লা গ্রামে পানের বরজ থেকে বছর আঠারোর এক তরুণীর মুণ্ডহীন দেহ উদ্ধার হয়। ঘটনায় নাম জড়ায় গ্রামেরই যুবক রামপদ মান্নার। মঙ্গলবার বাগুইআটি থেকে তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, অষ্টম শ্রেণিতেই পড়াশোনা ছেড়ে দেয় রামপদ। একই পাড়ার বাসিন্দা এক তরুণীর সঙ্গে প্রেম করে বিয়ে করে সে। প্রথম থেকেই টাকাপয়সার প্রতি প্রবল ঝোঁক ছিল রামপদর। বছর পাঁচেক আগে স্ত্রী ও তিন মেয়েকে নিয়ে গড়কিল্লা গ্রামের বাড়ি থেকে কলকাতার বাগুইহাটি চলে যায় রামপদ। সেখানেও সেলুন খোলে সে। পুলিশ জেনেছে, কলকাতায় তপন মান্না নাম নিয়ে থাকত সে।
আদালতের পথে অভিযুক্ত রামপদ মান্না।
পার্থপ্রতিম দাসের তোলা ছবি।
লক্ষ্মীপুজোর দিন গ্রামে মুণ্ডহীন তরুণীর দেহ উদ্ধারের ঘটনাতেই গ্রামে আলোড়ন পড়েছিল। পরে রামপদকে গ্রেফতারের পর সেই পুলিশকে দেখায় কোথায় মুণ্ডটা রয়েছে। ওই তরুণীর মৃতদেহের উপর যজ্ঞের বিভিন্ন সামগ্রী রাখা ছিল। প্রথম থেকেই পুলিশের অনুমান ছিল, এই ঘটনার সঙ্গে তন্ত্র সাধনার সম্পর্ক রয়েছে। গ্রেফতারের পর রামপদও জানায়, সে তন্ত্রসাধনার বিষয়ে বই কিনে পড়ত। তন্ত্র সাধনায় মাধ্যমে শক্তি, প্রতিপত্তি বৃদ্ধি এবং আর্থিক সমৃদ্ধি ঘটাতে বলির কথা রয়েছে। সেই আশাতে ওই তরুণীকে গ্রামে নিয়ে এমন কাণ্ড করে সে।
পূর্ব মেদিনীপুরের জেলা সদর তমলুক থেকে গড়কিল্লা গ্রামের দূরত্ব খুব বেশি হলে দশ কিলোমিটার। আর হলদিয়া-মেচেদা ৪১ নম্বর জাতীয় সড়ক থেকে এই এলাকার দূরত্ব মেরেকেটে দেড় কিলোমিটার। গ্রামের অধিকাংশ পরিবার চাষ এবং ব্যবসার কাজে জড়িত। এলাকাবাসীর আর্থিক অবস্থাও সচ্ছল। এলাকায় স্কুলে পড়তে যায় এলাকার ছেলেমেয়েরাও। অথচ এলাকাবাসীর অভিযোগ, অভিযুক্ত রামপদ মান্নার মতো অনেক তান্ত্রিকই ছড়িয়ে রয়েছে এই গ্রামে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশের অভিযোগ, গড়কিল্লা গ্রাম-সহ উত্তর উসুদপুর, দক্ষিণ উসুদপুর, খামারচক, হরশঙ্কর প্রভৃতি গ্রামে একাধিক তান্ত্রিক রয়েছে। ওই তান্ত্রিকেরা কোষ্ঠী বিচার, বাস্তু বন্ধ ছাড়াও বাড়িতে ভূত, কালপুরুষের উপদ্রব থেকে না কি রক্ষা পেতে উপায় বাতলে দেয়। এমনকি হারিয়ে যাওয়া ব্যক্তিকে খুঁজে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিজ্ঞাপন দেয় তারা। কয়েক মাস আগে চণ্ডীপুরের এক গ্রামে ‘নলধরকা’ করে একজনকে চোর ঠাওড়ে ছিল এক গুণিন। সে নিয়েও হইচই কম হয়নি। তারপর সেই গুণিনও ধরা পড়েনি।
গড়কিল্লা এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, ‘‘এলাকায় নানা অবৈধ কাজের অভিযোগ উঠলেও অনেকেই পুলিশ-প্রশাসনের কাছে অভিযোগ জানাতে চায় না। প্রশাসনও তাই ব্যবস্থা নেয় না।’’ এ দিন বাসিন্দারা মিছিল করে ঘটনায় অভিযুক্তের রামপদর কঠোর শাস্তির দাবি জানান।
সুধাংশবাবুর দেওয়া লিফলেটের বিজ্ঞাপনে অবশ্য নিজেকে ‘গুপ্ত তন্ত্রবিদ’ হিসেবে দাবি করা হয়েছে। এসব করছেন কেন? সুধাংশবাবুর উত্তর, ‘‘বাবার থেকে শিখে গত ১৭ বছর ধরে এটা করছি। এলাকার বাসিন্দাদের সমস্যা সমাধানে পরামর্শ দিয়েই থাকি!’