হাসপাতালের শয্যা থেকেই সোশ্যাল সাইটে আপডে়ট দিচ্ছেন সিপিএমের প্রাক্তন বিধায়ক। ‘ধীরে ধীরে সুস্থ হচ্ছি। আমার সহযোদ্ধারা রক্ষা না করলে প্রদীপ তা হয়ে যেতাম। কিন্তু ভীত নই। ওরা যত ভয় পাচ্ছে, তত মরিয়া হয়ে আক্রমণ করছে’। বর্ধমানে মিছিলের উপরে হামলায় প্রাণ হারিয়েছিলেন সিপিএমের প্রাক্তন বিধায়ক প্রদীপবাবু। সেই ঘটনার দিকেই ইঙ্গিত কামারহাটির প্রাক্তন বিধায়ক মানস মুখোপাধ্যায়ের।
বন্দর এলাকায় দলীয় প্রার্থীর সমর্থনে প্রচারের ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড করে বিজেপির রাজ্য নেতা রীতেশ তিওয়ারি মন্তব্য করছেন, ‘‘মানুষের সমর্থনে জয়ের আত্মবিশ্বাস তৃণমূলের নেই। তাই বিরোধীদের প্রচারে বাধা দিচ্ছে, হামলা করছে।’’
বাম হোক বা বিজেপি, পুরভোটে সাইবার-ময়দানে এখন এক ইঞ্চি জমিও ছাড়তে নারাজ বিরোধীরা। তৃণমূলের সঙ্গে রীতিমতো ধুন্ধুমার লড়াই চলছে তাদের! সাধ্যমতো আসরে আছে কংগ্রেসও। অথচ কলকাতার বেহালা থেকে বাগবাজার, টালা থেকে ট্যাংরা বা শহরতলির সোনারপুর থেকে কাঁচরাপাড়া— পুরভোটের বাজারে ঘুরে বেড়ালে ছবিটা ঠিক উল্টোই! দেওয়াল থেকে ফেস্টুন, রাস্তার ডিভাই়ডার থেকে অটোর পিঠ, সর্বত্র শুধু ফুটে আছে জোড়া ফুল! শহরের এক বিশিষ্ট চিকিৎসক তো বলেই ফেলছেন, ‘‘যে দিকে তাকাচ্ছি, শুধু একটাই দল! বিরোধীরা কোথায়? তারা তো আগেই ময়দান ছেড়ে পালিয়েছে মনে হচ্ছে!’’
বিরোধীরা অবশ্য দাবি করছেন, তাঁরা মোটেও পালাননি! আসলে শাসকের দাপটের কাছে বাহ্যিক প্রচারে পিছিয়ে পড়েছেন। ইতিউতি যেটুকু দেওয়ালে লেখার সুযোগ পেয়েছিলেন, শাসকের কব্জির জোরে তারও বহু ক্ষেত্রে নতিস্বীকার করতে হয়েছে। পতাকা-ফেস্টুন খুলে ফেলে দেওয়া তো আরওই সহজ! ভোট তো পরের কথা, প্রচারেই কাউকে দাঁত ফোটাতে না দেওয়ার জন্য জবরদস্তি চালাচ্ছে শাস়ক দল, সম্মিলিত অভিযোগ বিরোধীদের। অভিযোগ নস্যাৎ করে শাসক দলের অন্যতম শীর্ষ নেতা পার্থ চট্টোপাধ্যায় আবার যুক্তি দিচ্ছেন, এ সবই নিছক বাজার গরম করার চেষ্টা! সংগঠন না থাকার দুর্বলতা বিরোধীরা আড়াল করতে চাইছে সন্ত্রাসের অজুহাত খাড়া করে।
চাপানউতোর যেমনই হোক, ঘটনা হল এ বারের পুরভোটের অন্যতম লক্ষ্যণীয় বৈশিষ্ট্যই এই দুই দেওয়ালের দুই ছবি! রাস্তার দেওয়ালে যখন প্রায় একচেটিয়া শাসকের রাজত্ব, সোশ্যাল মিডিয়ার দেওয়ালে তখন দাপট বিরোধীদের। যে দেওয়াল দখলের কোনও ভয় নেই! বিজেপির রীতেশ যদিও কটাক্ষ করছেন, ‘‘নেহাত সুপ্রিম কোর্ট তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৬৬এ ধারাটা কেটে দিয়েছে তাই! নয়তো সাইবার মিডিয়াতেও তৃণমূল কাউকে জায়গা দিত না!’’
সাইবার মিডিয়াতেও তৃণমূল প্রত্যাশিত ভাবেই একেবারে হাত গুটিয়ে বসে নেই। রাস্তায় নেমে প্রথাগত প্রচারের পাশাপাশিই ফেসবুক এবং টুইটারে নিয়মিত মিলছে শাসক দলের প্রচারের নানা তথ্য। দলের রাজ্যসভার নেতা ডেরেক ও’ব্রায়েন ব্যক্তিগত ভাবে খেয়াল রাখছেন, পুরভোট হোক বা অন্য কিছু, তৃণমূলের হরেক তথ্য সাইবার জনতার হাতে অবিরত পৌঁছচ্ছে কি না। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পুরভোটের আনুষ্ঠানিক প্রচারে রাস্তায় নামার আগেই টুইটার এবং ফেসবুকে কাজ শুরু করে দিয়েছেন। আর তাঁর ঘোষিত কলকাতার মেয়র পদপ্রার্থী শোভন চট্টোপাধ্যায় এর মধ্যেও কামাল করে দিয়েছেন! নিজের ছবি সংবলিত পোস্টার নিজেই টুইট করে শোভন বলছেন, ‘কাজের মানুষ তোমাকে (শোভন) আবার চাই’!
টুইটে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সমানে পাল্লা দিচ্ছেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক এবং বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র। তাঁর টুইট আবার দ্রুত উঠে যাচ্ছে দলের ওয়েবসাইটে। পুরভোটের প্রচারে কোনও প্রান্তে কোনও ঘটনা ঘটলেই নিমেষে আপডেট দিচ্ছেন সাংসদ ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো তরুণ নেতারা। কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারের কারও কাছে কোনও বিষয়ে অভিযোগ জানালেও তার প্রতিলিপি তুলে দেওয়া হচ্ছে সোশ্যাল সাইটে। ঋতব্রতের কথায়, ‘‘এর ফলে দ্রুত মানুষের প্রতিক্রিয়া জানতে পারা যাচ্ছে। সমালোচনা থাকলে সেটাও জানা যাচ্ছে।’’ এই পথ ধরেই সিপিএমের নবীন-প্রবীণ দুই প্রজন্মের নেতা-কর্মীরাই এখন কামারহাটির হামলা হোক বা মালদহের বন্ধ, চোখের পলকে খবর ছড়িয়ে দিচ্ছেন সাইবার দুনিয়ায়।
দল হিসাবে বিজেপি অবশ্য সোশ্যাল সাইটকে এমনিতেই পেশাদারি কায়দায় ব্যবহার করে। পুরভোটের বাজারে তাদের সে আশ্রয় যেন আরও বেড়েছে! রীতেশ বলছেন, ‘‘নিজেদের আমলে সিপিএম গ্রামাঞ্চলে বিরোধীশূন্য ভোট করতে চাইত। পার্থবাবুরা আজ যেমন বলছেন, ২০০৩ সালের পঞ্চায়েত ভোটের সময় সেটাই বলেছিলেন প্রয়াত অনিল বিশ্বাস। কিন্তু তৃণমূল এখন শহরকেও বিরোধীশূন্য চাইছে!’’
সাইবার-হাতিয়ার আছে বলে সে ইচ্ছা না হয় সম্পূর্ণ করতে দিচ্ছেন না বিরোধীরা। শাসক দলের নেতারা কিন্তু বলে বেড়াচ্ছেন, ভোটটা তো ওয়েবে হবে না!