সে কালের লেখক এখন সুযোগ পেলে হয়তো লিখতেন, উন্নয়নের জলতরঙ্গ রোধিবে কে!
গৌতম দেব, অধীর চৌধুরী বা বাবুল সুপ্রিয়ের সাধ্য ছিল না এই তরঙ্গ রোখার! অবশ্য তরঙ্গ বললে কিছুই বোঝায় না। উন্নয়নের ঢেউ এ বারের তিন পুরভোটে রীতিমতো সুনামি হয়ে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছে রাজনীতির যাবতীয় হিসেব-নিকেশ! ‘জলমগ্ন’ হয়ে পড়েছে একের পর এক ওয়ার্ড, একের পর এক বুথ! দুর্জনেরা যাকে বলছেন, হিসেবে ‘জল’! জনাদেশ নামক দুধে দুধ কম, জলই বেশি!
গত বছরের লোকসভা ভোটের তুলনায় সদ্য অনুষ্ঠিত বিধাননগর, আসানসোল ও বালির পুর-নির্বাচনে শাসক দলের ভোট বেড়েছে, যাকে বলে ‘অবিশ্বাস্য’ হারে! বিধাননগরে ২৫.২%, আসানসোলে ১৭% এবং বালিতে প্রায় সাড়ে ৩৭%! যে হিসাব দেখে ভোট-পণ্ডিতদের চোখ কপালে উঠেছে! রাজ্য রাজনীতিতে গড়ে ৬-৭% ভোট এ দিক-ও দিক হলেই অতীতে অনেক চেনা ছক ওলটপালট হয়েছে। নির্বাচনের পরিভাষায় যাকে বলে ‘ভোট স্যুইং’। সেখানে ২৫ থেকে ৩৭% স্যুইং মানে ভবিষ্যতে রাজ্যের রাজনৈতিক চালচিত্র কী চেহারা নিতে চলেছে, ভেবেই কূল পাচ্ছেন না কেউ!
তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় সহজ কথায় ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তাঁদের এমন মহাজাগতিক সাফল্যের রহস্য আর কিছুই না! উন্নয়ন! তৃণমূলের নেতারা বলছেন, ২০১১ সালে পরিবর্তন এসেছিল বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে নেতিবাচক ভোটে। এখন চার বছর পার করে এসে তাঁরা সওয়ার হয়েছেন শাসক দলের পক্ষে ‘ইতিবাচক’ ভোটে। পার্থবাবুর কথায়, ‘‘বামফ্রন্ট সরকার ঋণের ভারে ডুবিয়ে রাজ্যকে অর্থনৈতিক অনটনে রেখে গিয়েছিল। তার মধ্যেও কঠোর পরিশ্রম করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যে উন্নয়ন এনে দিয়েছেন। শাসকের সঙ্গে সঙ্গে শাসনের পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। পিছনের সারি থেকে রাজ্যকে সামনে তুলে এনেছেন। বাংলাকে কী ভাবে বিশ্ববাংলায় পরিণত করা যায়, সেই স্বপ্ন দেখাচ্ছেন।’’ তাঁর দাবি, ‘‘এটাই জয়ের ম্যাজিক!’’
ম্যাজিক বলে ম্যাজিক! দেড় বছরের মধ্যে উন্নয়নের ম্যাজিক কেমন খেল দেখিয়েছে, একটু তথ্য দিয়ে বুঝে নেওয়া যাক। বিধাননগরের নবগঠিত পুর-নিগমের ৪১টি ওয়ার্ড ছড়িয়ে আছে বিধাননগর ও রাজারহাট-গোপালপুর বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে। ওই দু’টি বিধানসভা কেন্দ্রের গড় হিসাব ধরলে গত লোকসভা নির্বাচনে সেখানে তৃণমূল পেয়েছিল ৩৭.৫%। এ বার পুরভোটে সেই বিধাননগর পুর-এলাকাতেই তৃণমূলের ভোট বেড়ে হয়েছে ৬২.৭%। অর্থাৎ উন্নয়নের ম্যাজিকে এক লাফে ২৫%-এরও বেশি স্যুইং! এ বার তাকানো যাক আসানসোলের দিকে। বর্ধমান জেলার শিল্পাঞ্চলের এই নবগঠিত পুর-নিগমের ১০৬টি ওয়ার্ড ছড়িয়ে আছে রানিগঞ্জ, জামুড়িয়া, কুলটি ও আসানসোল উত্তর বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে। ওই চারটি বিধানসভা কেন্দ্রের গড় হিসাব অনুযায়ী গত লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূলের প্রাপ্ত ভোট ছিল ২৯.৮%। আর সদ্য হয়ে-যাওয়া পুরভোটে শাসক দলের খাতায় জমা হয়েছে ৪৭% ভোট। অর্থাৎ উন্নয়নের জোয়ার এখানে একটু কমই এসেছে! তাই ভোটবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ১৭%। কিন্তু বালি? সেখানে উন্নয়নের স্রোত সব ধরনের অঙ্কই ভাসিয়ে নিয়ে চলে গিয়েছে এ বার! বালি বিধানসভা এলাকায় গত লোকসভা নির্বাচনে শাসক দল যেখানে পেয়েছিল ৩৮.৬% ভোট, পুরভোটে সেটাই ৭৬% ছুঁয়েছে! যার মানে, উন্নয়নের ঘনঘটায় হাওড়ার এই শহরে জোড়া ফুলের বাক্সে এক্কেবারে প্রায় সা়ড়ে ৩৭% বাড়তি ফসল উঠেছে!
উন্নয়নের এমন স্রোত কি তাঁরা কখনও কল্পনা করেছিলেন? শিলিগুড়ির মেয়র তথা সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য অশোক ভট্টাচার্য পাল্টা প্রশ্ন তুলছেন, ‘‘তা হলে শিলিগুড়িতে কী হল? ওখানে প্রথমে পুরসভা, তার পরে মহকুমা পরিষদ তৃণমূল জিততে পারল না কেন? উন্নয়নের জোয়ার শিলিগুড়ি ঢোকার আগেই থেমে গেল!’’ অশোকবাবুদের এই প্রশ্নের জবাব অবশ্য দিয়েই রেখেছেন সুব্রত মুখোপাধ্যায়েরা। তাঁদের যুক্তি, শিলিগুড়িতে বিরোধীরা ‘অনৈতিক জোট’ করে মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে। প্রশ্ন তুলতে ছাড়ছেন না কংগ্রেসের বর্ষীয়ান বিধায়ক মানস ভুঁইয়াও। তাঁর প্রশ্ন, ‘‘এত যখন উন্নয়নের বান ডেকেছে চার দিকে, তা হলে গুন্ডা আর পুলিশ দিয়ে ভোট করাতে হচ্ছে কেন?’’ শাসক দলের নেতৃত্ব অবশ্য বিরোধীদের ঘাড়েই গু়ন্ডাবাহিনীর দায় চাপিয়ে দিয়েছেন।
এই চাপান-উতোরে উন্নয়নের গতি কিন্তু রুদ্ধ হয়ে যায়নি। সে এগিয়েছে তার নিজস্ব ছন্দে, নিজস্ব ইচ্ছায়। সে গতি এক এক জায়গায় এক এক রকম! আদর্শ উদাহরণ হতে পারে রাজারহাট। সেখানকার পুরসভার প্রাক্তন চেয়ারম্যান তাপস চট্টোপাধ্যায় যত দিন সিপিএমে ছিলেন, উন্নয়নের পথ রুদ্ধ হয়ে ছিল। কয়েক মাস আগে তিনি তৃণমূলে নাম লেখালেন। এ বার পুরভোটে অমনি উন্নয়নের জোয়ার হুড়হুড় করে ঢুকে গিয়ে তাপসবাবুকে ৭ হাজার ভোটে, তাঁর দলেরই সতীর্থ ডাম্পি মণ্ডলকে সাড়ে ৮ হাজার ভোটে জিতিয়ে দিল! সে উন্নয়ন এমনই পরাক্রমশালী যে, একটি বুথে তৃণমূল প্রার্থী তাপসবাবু যেখানে ৮৩৭ ভোট পেয়েছেন, সেখানে বাম, কংগ্রেস ও বিজেপি প্রার্থী পেয়েছেন যথাক্রমে ২, ১ ও ৬টি ভোট! কাছেই পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডের অন্য একটি বুথে তৃণমূল প্রার্থীর প্রাপ্ত ১০১৯টি ভোটের বিপরীতে বাম, কংগ্রেস ও বিজেপি প্রার্থীদের নামের পাশে পড়েছে যথাক্রমে ১২, ১ ও ৩টি ভোট! আবার বিধাননগর পুরসভারই ১৬ নম্বর ওয়ার্ডে তৃণমূলের সঞ্জীব বাগুই জিতলেন মাত্র ১৬০ ভোটে। উন্নয়নের স্রোত সেখানে এতই ক্ষীণ! আর বিধাননগরের ৭, ১২,১৩ ও ১৪ নম্বর ওয়ার্ড তো বলতে হবে উন্নয়নের মানচিত্র থেকেই বাদ! সেখানে উন্নয়নের সুনামির বাজারেও খটখটে শুকনো আবহাওয়া! জিতে বসে আছেন কংগ্রেস এবং সিপিএমের দু’জন করে মোট চার জন প্রার্থী!
উন্নয়নের এই কিস্সা কিন্তু এখানেই খতম নয়। কাহিনিতে আরও টুইস্ট আছে! যাকে বলে মোচড়! বিধাননগর, আসানসোল ও বালি— এই তিন পুর-এলাকাতেই গত বছর লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূলের ভোট কিন্তু ২০১১-র বিধানসভা নির্বাচনের তুলনায় বেশ কম ছিল। বিধাননগরে ২২.১%, আসানসোলে ২৩.৪% এবং বালিতে ১১.৮% ভোট কমেছিল তিন বছরে। অথচ মা-মাটি-মানুষের সরকার উন্নয়নের কাজ শুরু করে দিয়েছে সেই ২০১১ সাল থেকেই। প্রথম ১০০ দিনেই ৯৯% কাজ সম্পূর্ণ হয়ে গিয়েছে বলে ঘোষণা করে দিয়েছিলেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী। তা হলে উন্নয়নের ধারাবাহিক কর্মকাণ্ড সত্ত্বেও সরকার আসার তিন বছরের মাথায় শাসক দলের ভোট তিন শহরে কমে গেল আবার সাড়ে চার বছরের মাথায় একেবারে ছাদ ফুঁড়ে আকাশে উঠে গেল— এই নাটকীয় পতন-উত্থানের কী রহস্য?
তৃণমূলের মহাসচিব পার্থবাবুর ব্যাখ্যা, ‘‘লোকসভা ভোট স্থানীয় এলাকায় উন্নয়নের প্রশ্নে হয়নি। তখন দেশের সরকার গড়ার প্রশ্ন ছিল। তা ছাড়া, আমাদের কিছু আত্মসন্তুষ্টিও ছিল। এ বারেরটা উন্নয়নের ভোট।’’ শাসক দলের নেতারা এক বাক্যেই জানাচ্ছেন, ২০১৬-র দিকে তাকিয়ে উন্নয়নের রথ বিপুল বেগেই ছুটবে।
রকমসকম দেখে কংগ্রেসের এক নেতা বলছেন, ‘‘উন্নয়নের এমন প্লাবন চললে বিরোধীদের জন্য ত্রাণশিবির খুলে দিতে হবে!’’ আর তৃণমূলেরই এক বিধায়কের বিশ্লেষণ, ‘‘বাম সরকার ড্রপার দিয়ে উন্নয়ন দিত। কেউ পেত, কেউ পেত না। আমাদের সরকার পিচকিরি দিয়ে উন্নয়ন স্প্রে করছে!’’