তৃণমূলের গুন্ডাকে ভোট দিন।
কোনও লুকোনো-চুরোনো হুমকি নয়। বরং বড়-বড় হরফে শ্রীরামপুরের দেওয়ালে-দেওয়ালে এ কথাই লেখা!
শুধু কি নীরব দেওয়াল?
বৃহস্পতিবার দুপুরে পুরভোটের প্রচারের শেষ মুহূর্তেও জোড়াফুলের ঝান্ডা হাতে দোরে-দোরে গিয়ে হাত জোড় করে ছেলেপুলেরা বলেছে— ভোটটা গুন্ডাকেই দেবেন, প্লিজ...।
দাদাঠাকুর থাকলে হয়তো ফস করে ছড়া কেটে বসতেন, ‘‘কলিকালে কী না হয়! শাসকদল গুন্ডা নামায়।’’ কিন্তু হুগলির শ্রীরামপুর পুরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের ভোটারেরা একটুও বিচলিত নন, অবাক তো ননই।
‘গুন্ডা’ মানে তো হাতা গুটোনো, মাসল ফোলানো কুস্তি করা স্যান্ডো ছোঁড়া নয়! গুন্ডার বয়স ৬৪। স্কুলের খাতায় নাম ছিল পিনাকী ভট্টাচার্য। ভোটের খাতাতেও তাই। একেবারে ছোটবেলায় নাতির দস্যিপনা দেখে গুন্ডা বলে ডাকতে শুরু করেছিলেন যিনি, সেই দাদু কালীপ্রসন্ন ভট্টাচার্য কবেই ভোট-ফোটের চক্কর ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছেন। কিন্তু নামটি থেকে গিয়েছে। ‘পিনাকী’ নাম বলে খুঁজলে পাশের বাড়ির লোকই খানিকক্ষণ হাঁ করে চেয়ে থাকবে, কিন্তু গুন্ডা নাম মুখে আনা মাত্র পাড়ার মোড়ে ঝুপসি গাছের ডালে বসা কাকও দেখিয়ে দেবে, ‘ওই যে...।’
এই যখন নাম-মাহাত্ম্য, ভোটের প্রচারে প্রার্থীর ডাকনাম না লিখেই বা উপায় কী? সে যতই বদনামের ভয় থাক আর বিরোধীরা খোরাক করুক। পিনাকী ভট্টাচার্য লিখেও তাই পাশে ব্র্যাকেটে লিখে দিতে হচ্ছে ‘গুন্ডা’। তাঁর এই গুন্ডাগিরি ঠেকাতে কোমর বেঁধেছেন বিজেপির শ্যামা অর্থাৎ শ্যামল বসু এবং কংগ্রেসের সমীর দে ওরফে বাবু। কবাডি জমে উঠেছে!
সিউড়িতে ১ নম্বর ওয়ার্ডে নির্দল প্রার্থী সপ্তম দাসের দেওয়াল লিখন
ও শ্রীরামপুরে ১৯ নম্বর ওয়ার্ডে তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থীর প্রচার।
পুরভোটের বাজারে এ হেন সব ডাকনামেরই ছড়াছড়ি বহু এলাকায়।
বাম আমলে লোকাল-জোনালকে জিগ্যেস না করে যখন পাড়ার পিছনে সু্য্যি ডুবত না, লাইটপোস্টে ডুমও জ্বলত না, অনেকেরই ধারণা ছিল সিপিএমের গেরেমভারি নেতাদের কোনও ডাকনাম থাকতেই পারে না! বাড়িতে বাবা-কাকারাও ‘কমরেড জ্যোতিপ্রকাশ, খেতে এসো’ বা ‘কমঃ রামনিবাস, রেশন তুলতে ভুলো না’ বলে কথা বলতেন। এ হেন ধারণা অবশ্যই ঠিক নয়। যেমন, সিপিএমের মুর্শিদাবাদ জেলা সম্পাদক মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য গত তিন দশক টানা জঙ্গিপুর পুরসভায় প্রার্থী হয়ে এসেছেন। তাঁর নামের পাশে দেওয়ালে ডাকনাম ‘ভোদন’ স্পষ্ট লেখা থাকত।
আর এখন তো বাম-ডান নির্বিশেষে সব ডাকনাম হইহই করে বেরিয়ে পড়েছে। মৃগাঙ্কবাবু এখন আর দাঁড়ান না। কিন্তু তাঁর শহরে তাঁরই দলের দুই মোজাহারুল ইসলাম প্রার্থী হয়েছেন। ৩ নম্বর ওয়ার্ডে বিদায়ী পুরপ্রধান মোজাহারুল। পাশে ১ নম্বরে আর এক মোজহারুল, তিনি বিদায়ী কাউন্সিলর। এক নামের ফেরে একটা ‘ভ্রান্তিবিলাস-২’ হয়ে যাওয়ার দিব্যি সম্ভাবনা ছিল। বাঁচিয়েছে সেই ডাকনাম। বিদায়ী পুরপ্রধানের নাম ‘মোজা’, অন্য জনের ‘আজা’। চিনতে কারও কোনও সমস্যাই নেই। বয়েই গিয়েছে হারুল-ফারুল মনে রাখতে! ১৬ নম্বর ওয়ার্ডে রঙ্গনা সাহার পাশে বন্ধনীতে ঠাঁই নিয়েছে ‘পম্পা’। ১৯ নম্বরে সুরেশ চক্রবর্তীও নামের পাশে বড় করে ‘ফুচা’ লিখিয়েছেন।
কংগ্রেসী ভোট-সংস্কৃতিতে অবশ্য ডাকনাম লেখার রেওয়াজ চিরকালই ছিল। এ বার যেমন ফুচার বিরুদ্ধে তৃণমূলের হয়ে দাঁড়ানো তৃণমূল প্রার্থী গৌতম রুদ্র তাঁর ভাল নামটা ব্যবহার করার প্রয়োজনই বোধ করেননি। বরং সোজাসাপ্টা লিখে দেওয়া হয়েছে— ‘‘বাবুয়াকে ভোট দিন।’’ ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল প্রার্থী ‘শ্যামাপ্রসাদ দাস’ যে অনেক দিনের চেনা বাবলুরই স্কুলের নাম বা কংগ্রেস প্রার্থী গুড্ডুকে নির্বাচন কমিশন ‘অমিত সরকার’ নামে জানে, তা দেওয়াল দেখেই জানতে পেরেছেন এলাকার লোক। নবদ্বীপের দেয়ারাপাড়া রোডে আশিস চক্রবর্তীর বাড়ি সহজে খুঁজে পেতে চাইলে ‘দনুদের বাড়ি’ বললেই হবে। পরপর দু’বার তিনি ১৮ নম্বর ওয়ার্ড থেকে কংগ্রেসের টিকিটে জিতেছেন। এ বার দল পাল্টে তিনি তৃণমূলের। কিন্তু নাম পাল্টায়নি। ফ্লেক্স থেকে দেওয়ালে ‘দনু’ নামেরই দাপাদাপি।
কিছু চেনা নাম আবার দেওয়ালে-ব্যানারে মুখ দেখিয়ে অচেনা লোকের চোখ কপালে তুলেছে।
জঙ্গিপুরে তিন নম্বর ওয়ার্ডে সিপিএম প্রার্থী মোজাহারুল ইসলামের
সমর্থনে ও ১৯ নম্বরে সিপিএম প্রার্থ সুরেশ চক্রবর্তীর দেওয়াল লিখন।
শ্রীরামপুরে যেমন দিনে-দুপুরেও হাসি মুখে ভোট চাইছেন ‘ভূত’। নাতি ‘শিবের বার’ সোমবারে জন্মানোয় দাদু বড় সাধ করে নাম রেখেছিলেন ভূতনাথ। পরে ক্রিকেটে আম্পায়ারিং করতে গিয়ে তাঁর ‘নাথ’ বাউন্ডারি পেরিয়ে হাওয়া। ছোট্ট করে শুধু ‘ভূত’ রয়ে গিয়েছে। অগত্যা সেই নামেই ভোট চাইছেন ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল প্রার্থী অসীম পণ্ডিত। ভূতের রাজার বরও না কি তাঁর ঝুলিতে!
হুগলির উত্তরপাড়ায় ১৪ নম্বর ওয়ার্ডে সিপিএমের প্রার্থী প্রসূন ঘোষ চকোলেট বোমা হয়ে ফেটে পড়তে পারেন যে কোনও সময়ে। কে যেন কখন তাঁর নাম রেখেছিল ‘বাজি’ এবং তা দিয়েই ভোটের দেওয়ালে তিনি বাজিমাত করতে চাইছেন। বীরভূমে সিউড়ি ১ নম্বর ওয়ার্ডের দেওয়ালে রংবেরঙে লেখা— ‘ডাবকে আপেল চিহ্নে ভোট দিন।’ নির্দল প্রার্থী সপ্তম দাসকে জন্মাবধি ‘ডাব’ নামেই চেনে পাড়ার লোকে।
কী আর করা!