কাঁচরাপাড়ার দলীয় কার্যালয়ে মুকুল রায়। ছবি:সজল চট্টোপাধ্যায়
চব্বিশ ঘণ্টা আগেই ‘বাবার অসম্মানের’ জবাব দিতে খোদ দলনেত্রীকে আক্রমণ করেছেন পুত্র। পুত্রগর্বে গর্বিত হলেও এখনই বিদ্রোহের ঝোড়ো ইনিংস খেলে তড়িঘড়ি আউট হওয়ার ঝুঁকি নিতে চান না তৃণমূলে কোণঠাসা মুকুল রায়। তিনি জানেন, ‘ক্রিজে থাকলে রান আসবে’।
জোড়া উপনির্বাচনের ফল প্রকাশের পরের দিনই দলীয় সংগঠনে মুকুলের ডানা পুরোপুরি ছেঁটে দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই অবস্থায় মুকুল বিজেপিতে যোগ দিতে পারেন বলে জল্পনা তুঙ্গে। বৃহস্পতিবার নিজের বাড়িতে তৃণমূলের বৈঠকে মুকুলের নাম না-করে মমতা হুঁশিয়ারি দেন, ‘আক্রমণ করতে এলে প্রয়োজনে বাঘের নখ উপড়ে আনতে পারি’। যার জবাবে শুক্রবার মুকুল-পুত্র শুভ্রাংশু দাবি করেছিলেন, আক্রান্ত হচ্ছেন তাঁর বাবাই। তিনি বাবার পাশে আছেন। কারণ, ছেলে হিসেবে বাবার সম্মানই তাঁর কাছে সবার আগে।
শুভ্রাংশুর এই জেহাদে তিনি যে গর্বিত, সে কথা এ দিন রাখঢাক না-করেই জানিয়ে দিয়েছেন মুকুল। তাঁর কথায়, “আজকাল তো বাবা পুরনো হলে ছেলে পাশে থাকে না! শুভ্রাংশু আমার পাশে রয়েছে। অন্য লোকেরা কারও ছত্রচ্ছায়ায় বা কারও আঁচলের তলায় বাঁচতে চায়। আমি খুশি, শুভ্রাংশু স্বতন্ত্র পরিচয়ে বাঁচতে চেয়েছে।”
স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, এই কটাক্ষের লক্ষ্য কি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়? মমতার ভাইপো বলে তিনি বাড়তি গুরুত্ব পাচ্ছেন, এমন অভিযোগের গুঞ্জন তৃণমূলেই রয়েছে। কৌশলী মুকুল অবশ্য বলছেন, “এটাও অন্যায়। প্রত্যেকেরই নিজস্ব পরিচয় আছে।”
শুভ্রাংশুর জন্য গর্বিত হলেও তিনি দলের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তুলেছেন, তা নিয়ে কোনও আলোচনায় যেতে চাইছেন না মুকুল। শুভ্রাংশুর বিরুদ্ধে শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগ এনেছে দল। তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে বলেও জানানো হয়েছে। সরাসরি সেই প্রসঙ্গে ঢুকতে নারাজ মুকুলের কৌশলী মন্তব্য, “গণতান্ত্রিক দেশে কথা বলার অধিকার প্রত্যেকের আছে। ওর আক্ষেপ থাকতেই পারে। শুভ্রাংশুর বক্তব্য নিয়ে আমার কিছু বলার নেই।”
মুকুল-ঘনিষ্ঠদের মতে, আসলে পরিস্থিতির বিচারে এখন জল মাপছেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক। জোড়া উপনির্বাচনে মমতার সাফল্যের পর এই মুহূর্তে পৃথক দল বা মঞ্চ গড়ার মতো লোকজন জোটানো মুশকিল। অন্য দিকে, মুকুলকে দলে নেওয়া হবে কি না, তা নিয়ে দোলাচল রয়েছে বিজেপির অন্দরে। এক পক্ষের মতে, মুকুলকে এখনই দলে নিয়ে তাঁর সাংগঠনিক শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিধানসভা ভোটের আগে তৃণমূলকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া হোক। অন্য পক্ষের বক্তব্য, সারদা কেলেঙ্কারিতে সিবিআই মুকুলকে পুরোপুরি ছাড়পত্র দেওয়ার আগে তাঁকে দলে নেওয়া উচিত নয়। তাতে নীতির প্রশ্নে আপস করা হবে। দলীয় সূত্রের খবর, মুকুলকে এখনই না-নেওয়ার পক্ষের দিকেই পাল্লা ক্রমশ ভারী হচ্ছে।
এই অবস্থায় মুকুলের সামনে খুব বেশি পথ খোলা নেই বলেই তৃণমূল নেতাদের অনেকের অভিমত। বিদ্রোহের ধ্বজা তুলে দল ছাড়ার অসুবিধা যেমন রয়েছে, তেমনই একেবারে নীরবে মাথা নত করে ফেললে প্রমাণিত হবে, দলনেত্রীর কাছে তিনি বশ্যতা স্বীকার করেছেন। সেই কারণেই মমতার সঙ্গে সম্মুখ সমরে না-গিয়ে ছেলের জেহাদকে সমর্থন করে তিনি কৌশলে দ্বৈরথ চালিয়ে যেতে চাইছেন বলে তৃণমূল সূত্রের ব্যাখ্যা। তৃণমূলের অনেকে এ-ও মনে করছেন, মুকুল এখনই দল ছাড়বেন না। দলে থেকে এ ভাবেই নেতৃত্বকে খোঁচা দিয়ে যাবেন। আর মুকুলের নিজের কথায়, “আমি এখন কুমিরের মতো ভেসে থাকতে চাই।”
ক্রিকেটের প্রতি মুকুলের আগ্রহ সর্বজনবিদিত। কম বয়সে নিজে খেলতেনও। সেই প্রসঙ্গ টেনেই এ দিন নিজাম প্যালেসে তিনি বলেন, “আমি যত দিন ক্রিকেট খেলেছি, তত দিন রক্ষণাত্মক খেলাই খেলেছি। আমার সহ-খেলোয়াড়দের বলতাম, ‘হাঁকপাঁক করিস না। যত ক্ষণ পারিস ক্রিজে থাক। রান পাবি।’ আমার মানসিকতা টেস্ট খেলার।”
মুকুল-শিবির বলছে, রাজনীতিতে ধৈর্য একটা অন্যতম শিক্ষা। খারাপ সময়ে মাথা ঠান্ডা রাখতে পারাটা বড় রাজনীতিকের লক্ষণ। কারণ, রাজনীতিতে চিরস্থায়ী বলে কিছু হয় না। সময়ে সব কিছুই পাল্টায়। বস্তুত, ক্রিকেটের ভাষাতেই এ দিন সহকর্মীদের সেই শিক্ষা দিয়েছেন মুকুল। বলেছেন, “প্রতিপক্ষ তো স্লেজিং করবেই। ফাঁদে পা দেওয়া চলবে না।”
তৃণমূল তাঁকে কার্যত দরজা দেখিয়ে দিলেও মাথা ঠান্ডা রেখেই ‘ফাঁদে পা’ দিচ্ছেন না মুকুল। এখনও পর্যন্ত এক বারের জন্যও দল বিরোধী কথা বলেননি। এ দিন কাঁচরাপাড়ার বাড়ি থেকে বেরিয়ে পার্টি অফিসে এসেও বলেছেন, “নিজের হাতে যে দল গড়েছি, সেই দল ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ারও পরিকল্পনা করিনি। দলের ঊর্ধ্বে কেউ নন। দলে অপরিহার্যও কেউ নন।” কিন্তু তাঁর দল বদল বা পৃথক মঞ্চ গড়া নিয়ে যে জল্পনা চলছে? এ বারেও মুকুলের কৌশলী জবাব, “ওই বিষয়ে যা বলার, সময়ই বলবে।” মুকুল নিজে এ কথা বললেও এ দিন বারাসতের ডাকবাংলো মোড়ে ইঙ্গিতবাহী বেশ কিছু ফেস্টুন নজরে পড়ে। সেগুলিতে লেখা ছিল ‘মুকুল রায় এগিয়ে চলো, আমরা তোমার সাথে আছি’। পরে পোস্টারগুলি কে বা কারা খুলে দেয়।
এখনও সংসদীয় দলের চেয়ারম্যান থাকা সত্ত্বেও সংসদীয় কাজকর্মে তাঁকে ব্রাত্য করে ফেলেছে দল। আজ, রবিবার বিকেলে তবু দিল্লি যাচ্ছেন মুকুল, বাজেট অধিবেশনে যোগ দিতে। থাকবেন ২৮ তারিখ বাজেট পেশ না-হওয়া পর্যন্ত। তিনি যে ক্রিজ কামড়ে পড়ে থাকায় বিশ্বাসী!