নিজাম প্যালেসে মুকুল রায়। রবিবার রণজিৎ নন্দীর তোলা ছবি।
দলের সব পদ থেকে অপসারিত হওয়ার পরেও সরাসরি আক্রমণ নয়। বরং পরোক্ষে তৃণমূলকে খোঁচা দেওয়ার কৌশলই অব্যাহত রাখলেন মুকুল রায়। পাশাপাশি দলেরও একাধিক নেতা, কেউ নাম করে, কেউ না করে তাঁকে বিঁধে গেলেন দিনভর! যা দেখেশুনে সদ্য পদ খোয়ানো মুকুলের সহাস্য জবাব, “যা ঘটছে, তা উপভোগ করছি!”
তৃণমূলের প্রতিষ্ঠাতা সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক পদ হারানোর ঘোষণা হয়েছে শনিবার। তার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই দ্বিমুখী কৌশল নিয়ে মাঠে নামেন মুকুল। প্রথমত তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন, আগামী বিধানসভা নির্বাচনে শাসক দলের মূল্যায়ন হবে পরিবর্তন-পরবর্তী সময়ের কাজের ভিত্তিতে। অর্থাৎ ৩৪ বছরের বাম আমলের কাসুন্দি ঘেঁটে জনগণের মন ধরে রাখা যে কঠিন, এই বাস্তব দলকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। রবিবার নিজাম প্যালেসে বসে মুকুল বলেন, “২০১১ সালে ৩৪ বছরের বাম শাসনের পরিবর্তন হয়েছে। এ বার মানুষ কী দেখবেন? আমরা যে পরিবর্তন চেয়েছিলাম, তৃণমূল কি সেই প্রত্যাশা পূরণ করতে পেরেছে? আগামী আট মাস থেকে এক বছর মানুষ এটা নিয়েই চর্চা করবেন।” আগামী বিধানসভা ভোটে এ সবের প্রভাব পড়বে কি? জল্পনা উস্কে মুকুলের কৌশলী মন্তব্য, “সিপিএমকে সরাতে ৩৪ বছর লেগেছে। পরের সরকারকে সরাতে ৬৮ বছর লাগবে না ৬৮ দিন লাগবে, সেটা তো সময়ই ঠিক করবে।”
দ্বিতীয়ত মুকুল এ দিন তৃণমূলের অন্দরের বিভাজনকে ফের উস্কে দিতে চেয়েছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাইপো অভিষেককে সংগঠনে তুলে ধরতে গিয়ে তমলুকের সাংসদ শুভেন্দু অধিকারীকে দলের যুব শাখার দায়িত্ব থেকে সরানো নিয়ে আগেই মুখ খুলেছিলেন মুকুল। এ দিন ফের তিনি শুভেন্দুকে নিয়ে দলীয় নেতৃত্বের বিরুদ্ধে কৌশলী কটাক্ষ করেন। শনিবারই শুভেন্দুকে দলের কার্যকরী কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদে উন্নীত করেছেন দলনেত্রী। এ দিন মুকুল বলেন, “শুভেন্দুকে আরও বেশি দায়িত্ব দেওয়া উচিত ছিল।” ঘটনাচক্রে এ দিনই সাসপেন্ড হওয়া সিউড়ির তৃণমূল বিধায়ক স্বপনকান্তি ঘোষও জানিয়েছেন, শুভেন্দুকে আরও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া উচিত। তবে মুকুল বা স্বপনকান্তির বক্তব্য নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি শুভেন্দু।
তৃণমূল সরকারের কাজের মূল্যায়ন প্রসঙ্গে মুকুলের মন্তব্য নিয়ে এ দিন তৃণমূলের ভিতরে-বাইরে জল্পনা শুরু হয়েছে। রাজ্যের আইনশৃঙ্খলার অবনতি, শিক্ষাক্ষেত্রে নৈরাজ্য, বেহাল স্বাস্থ্য পরিষেবা, শিল্পের করুণ দশা এবং সর্বস্তরে দুর্নীতি নিয়ে প্রতিদিনই সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনায় সরব বিরোধীরা। এই পরিস্থিতিতে তৃণমূল সরকারের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণ প্রসঙ্গে মুকুল ঠিক কী বলতে চেয়েছেন, তা নিয়ে দলের অনেকেই নানা ব্যাখ্যা করেছেন। কারণ, মুকুল দলের নাড়ির খবর রাখেন। পরবর্তী সময়ে ঝুলি থেকে তিনি কী বার করবেন, তা নিয়েও দলের অনেকেরই আশঙ্কা রয়েছে। বিশেষত সারদা-কাণ্ডে সিবিআইকে সহযোগিতার যে কথা তিনি বারেবারে বলছেন, তা নিয়ে তৃণমূলের অন্দরে অনেকেই চিন্তিত।
মুকুলের মন্তব্য প্রসঙ্গে কংগ্রেস নেতা তথা আইনজীবী অরুণাভ ঘোষ বলেন, “তৃণমূল রাজত্বের প্রায় চার বছরে রাজ্যে আর কিছু হোক না হোক, মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিতে একটা পরিবর্তন হয়েছে। সততা এখন খুঁজে দেখতে হয়! শাসক দলের জনপ্রতিনিধিদের গায়ে কালি নেই, এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া মুশকিল!” একই সঙ্গে তিনি বলেন, “এই সরকারের আমলে বাংলায় ধর্মীয় ভাবে ‘আমরা-ওরা’র যে বিভাজন তৈরি হয়েছে, বিভিন্ন ভোটে তার প্রমাণ মিলেছে।” অরুণাভবাবুর বক্তব্য, তৃণমূল জমানার এই বদল যে রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে রাজ্যের ক্ষতি করেছে, তা মুকুলের বক্তব্যের পরে মানুষকে ভাবাবে।
তৃণমূল নেতৃত্বের একাংশ অবশ্য মনে করেন, সমস্ত পদ হারানোর পরে মুকুল এখন ‘দায়হীন’। তাই এমন নানা প্রসঙ্গ সামনে এনে মুকুল লাগাতার দলকে অস্বস্তিতে ফেলার চেষ্টা চালিয়ে যাবেন। তবে এ সবে গুরুত্ব দিতে নারাজ তৃণমূলের শীর্ষ নেতারা। এ দিন কল্যাণীতে দলের অনুষ্ঠানে যান তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং দলের নতুন সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক সুব্রত বক্সী। সেখানে পার্থবাবু বলেন, “আমাদের বাড়ির (তৃণমূল) ইট ভাঙার ক্ষমতা কারও নেই। প্রতিটি ইট যত্ন করে গাঁথা। আমাদের বাড়ি ভাল মিস্ত্রির হাতে তৈরি।” সেই মিস্ত্রি যে দলনেত্রী, তা-ও স্পষ্ট করে দেন পার্থবাবু। এ দিন উত্তর কলকাতার ১১ নম্বর ওয়ার্ডের দলীয় কর্মী সম্মেলনে দলের প্রবীন নেতা ও মন্ত্রী সাধন পাণ্ডেও মুকুলের সমালোচনা করেন। ক’দিন আগেই দলের লাইনের বাইরে গিয়ে কথা বলে বিতর্কে জড়িয়ে পড়া সাধনবাবু এ দিন বলেন, “ও এখন বিজেপির খপ্পরে পড়ে গিয়েছে! বিজেপির খপ্পরে যদি কেউ পড়ে যায়, তাকে মানুষ পছন্দ করে না।” ওই সভাতেই মুকুলকে দলের একজন ‘কেরানি’ বলে অভিহিত করেন কলকাতা পুরসভার মেয়র পারিষদ অতীন ঘোষ।
মুকুল অবশ্য এই ধরনের ইটের জবাবে পাল্টা পাটকেল ছোড়েননি! অতীনের মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে শুধু বলেন, “দলে কেরানিও লাগে, আবার অন্য কাজেও কাউকে দরকার হয়!” দলের সব পদ খোয়ানোর পরেই সহকর্মীদের এমন প্রত্যাঘাতের জবাবে হাসতে হাসতেই বলেছেন, “যা ঘটছে, তা উপভোগ করছি! রাজনীতিতে ছিলাম, আছি, থাকব।” আজ, সোমবার ভোরেই তিনি ফের দিল্লি যাবেন। সংসদের অধিবেশনে যোগ দিতে। কিন্তু তাঁর আসন তো বদলে গিয়েছে! প্রথম সারির আসন থেকে এখন পিছনে তৃতীয় সারিতে বসতে হবে। এটা ভাল লাগবে? মুকুলের জবাব, “ভাল মন্দের কী আছে? এটা জীবনের একটা অঙ্গ।”
শনিবার রাতেই দিল্লি থেকে ফিরে কাঁচরাপাড়ার বাড়িতে যান মুকুল। এ দিন সকালে তাঁর বাড়ির সামনে ভিড় জমান অনুগামীরা। ভিড় দেখে আপ্লুত মুকুল বলেন, “জনগণ আমার পাশে আছে। আমিও জনগণের পাশে আছি। আমাদের বাড়ির সামনে ভিড়ই তার প্রমাণ।” এ দিন বিকেলে আবার কাঁচরাপাড়াতে তৃণমূল বিধায়ক অর্জুন সিংহের নেতৃত্বে একটি মুকুল-বিরোধী মিছিল হয়! দল যে ভাবে তাঁকে পদহারা করেছে, তা নিয়ে তিনি কী ভাবছেন? হাসতে হাসতে মুকুলের জবাব, “দলের সঙ্গে বিরোধের প্রশ্ন নেই। আমাকে দল বহিষ্কারও করতে পারে। দল যা করেছে, ঠিকই করেছে।” সেই সঙ্গে দলের নয়া কার্যকরী কমিটি সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য, “ওঁরা খুবই দক্ষ। কেন্দ্রের ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে এটা নয়া শুরুয়াৎ। শুভেচ্ছা রইল।”
পদ হারানো মুকুলকে নিয়ে এখন একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে রাজনৈতিক মহলে। মুকুল কি অন্য দলে যোগ দিচ্ছেন বা নতুন দল গড়ছেন? স্পষ্ট জবাব না দিলেও মুকুল জানিয়েছেন কংগ্রেস থেকে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। এমনকী সিপিএমের এক শীর্ষ নেতাও তাঁকে ‘সাবধানে’ থাকার পরামর্শ দিয়েছেন বলে মুকুল এ দিন জানান। তবে মুকুলের সঙ্গে তাঁর দলের নেতাদের যোগাযোগ প্রশ্নে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী বলেন, “কংগ্রেস পাপের বোঝা বইতে চায় না। উনি কংগ্রেসে ফিরতে চান কি না, তা-ও আমার জানা নেই।”
একদা ক্রিকেটার মুকুল এখন কোন স্টান্স নেন, সেটাই দেখার।