দূরে দূরেই রইলেন তৃতীয় মুকুল

মাইক নিয়ে একা হাতে তৃণমূল নেত্রীর সভা সামলাতে দেখা যেত তাঁকে। তিনি মুকুল রায়-১। দোর্দণ্ডপ্রতাপ। এর পর শুরু দূরত্বের সময়। তখন তিনি একা শিলিগুড়ি সফরে এলে আড়ালে আবডালে লুকিয়ে পড়েছেন দলের নেতারা। খাবার ঠিকই পৌঁছে গিয়েছে তাঁর বাংলোয়। ব্যবস্থা হয়েছে গাড়িরও। কিন্তু কে করেছে, জানে না কেউ-ই! তিনি মুকুল রায়-২। নিঃসঙ্গ।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শিলিগুড়ি শেষ আপডেট: ২২ জানুয়ারি ২০১৬ ০৩:৫৯
Share:

পাশে, তবু কাছে কি? শালুগাড়ার অনুষ্ঠান মঞ্চে মুখ্যমন্ত্রী। রয়েছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ও মুকুল রায়। ছবি: সন্দীপ পাল।

মাইক নিয়ে একা হাতে তৃণমূল নেত্রীর সভা সামলাতে দেখা যেত তাঁকে। তিনি মুকুল রায়-১। দোর্দণ্ডপ্রতাপ।

Advertisement

এর পর শুরু দূরত্বের সময়। তখন তিনি একা শিলিগুড়ি সফরে এলে আড়ালে আবডালে লুকিয়ে পড়েছেন দলের নেতারা। খাবার ঠিকই পৌঁছে গিয়েছে তাঁর বাংলোয়। ব্যবস্থা হয়েছে গাড়িরও। কিন্তু কে করেছে, জানে না কেউ-ই! তিনি মুকুল রায়-২। নিঃসঙ্গ।

বৃহস্পতিবার তৃণমূল নেত্রীর সঙ্গে যিনি নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে নামলেন, তিনি এ সবের থেকেই আলাদা। শীর্ষ নেত্রীর সঙ্গে এসেছেন, আছেন সব অনুষ্ঠানেই। অথচ কোথাও যেন নেই-ও।

Advertisement

তিনি মুকুল রায়-৩। যাঁকে এ দিন দেখার পরে অনেকেই বলছেন, দলনেত্রীর পিছন পিছন শিলিগুড়ি, দার্জিলিং করলেও এই মুকুল কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কাছের বা পাশের লোক’ নন! বরং প্রকাশ্যে দূরত্ব যেন রয়েই গেল। যা দেখে স্থানীয় তৃণমূল নেতাদেরই এক জন মনে করিয়ে দিলেন শচীন কর্তার সেই বিখ্যাত গান: তুমি আর নেই সে তুমি!

কী রকম? বুধবার শিয়ালদহ স্টেশনে পদাতিক এক্সপ্রেসে ওঠার সময় মমতার খানিক পিছনে ছিলেন মুকুল। বৃহস্পতিবার সকালে এনজেপি স্টেশনেও একই ছবি। অবশ্য উত্তরকন্যায় যাওয়ার আগে নিজের গাড়িতে মুকুলকে ডেকে নেন মুখ্যমন্ত্রী। সাফারি পার্কের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে অনেক দিন পর মমতার সঙ্গে এক মঞ্চে উঠলেন। কিন্তু উঠলেন সকলের পরে। তত ক্ষণে মুখ্যমন্ত্রী তো বটেই, দুই মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস ও গৌতম দেব, সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং পুলিশ-প্রশাসনের কর্তারা সকলেই মঞ্চে উঠে পড়েছেন। কারও সঙ্গে কথা না বলে গিয়ে বসলেন মঞ্চের বাঁ কোণে, প্রায় শেষ প্রান্তে। মমতার থেকে চারটি চেয়ার পরে। ঘণ্টাখানেকের অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী শুধু এক বার নাম উল্লেখ করলেন তাঁর। কিন্তু এক বারও ডেকে কথা বলেননি। আবার মুকুলও চেয়ার ছেড়ে এগিয়ে যাননি কখনও। এমনকী, কেউ এগিয়ে এসে তাঁর সঙ্গে কথাও বলেননি। একটা আড়ষ্ট ভাব ঘুরে বেড়িয়েছে অন্যদের মধ্যেও। শুধু জলপাইগুড়ির সাংসদ বিজয়চন্দ্র বর্মনের সঙ্গে বার কয়েক টুকটাক কথা বলতে দেখা গিয়েছে তাঁকে।

এক সময় তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে সভার কাজকর্ম দেখাশোনা করছিলেন জলপাইগুড়ির জেলাশাসক পৃথা সরকার। পরে পৃথাদেবী বিষয়টি টের পেয়ে ফিরে মুকুলবাবুকে দেখেন এবং পিছিয়ে যান। তা দেখে মুকুল নিজেই বলে উঠলেন, ‘‘আরে কোনও ব্যাপার নয়, কাজ করুন না!’’

এমন অনুষ্ঠানে এক সময় তিনি যা যা করতেন, সেটাই এ দিন করলেন অরূপ ও গৌতম। বসে বসে দেখলেন মুকুল। মাঝে মোটে এক জনের ব্যবধান। তবু এক বারের জন্যও চোখাচোখি হল না অভিষেকের সঙ্গে। বরং দু’জনেই যেন দু’জনের থেকে দূরে থাকতে ব্যস্ত রইলেন।

মঞ্চের নীচে দাঁড়িয়ে সবই চোখে পড়ছিল তৃণমূল কর্মী-সমর্থকদের। কেউ কেউ তো বলেই ফেললেন, ‘‘সরকারি হোক বা দলের অনুষ্ঠান, এক সময় একা হাতে সব সামলাতে দেখেছি মুকুলদাকে। অনুষ্ঠান শুরু হওয়া থেকে মুখ্যমন্ত্রী আসার আগে, মাইক হাতে গোটা সময় মঞ্চ সামলাতেন। এ বার দেখছি সব উধাও!’’ পাশে আর এক জন দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বললেন, ‘‘দেড় বছরে দূরত্ব অনেকটাই বেড়েছে দেখছি। তবে কমবেও নিশ্চয়ই।’’

যদিও প্রকাশ্যে দেখতে পাওয়া এই ছবিটিকেই শেষ কথা বলে মনে করছেন না রাজনীতির অনেকে। বরং তাঁরা বলছেন, মুকুলকে তো মমতা নিজেই উত্তরবঙ্গ সফরে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। সম্প্রতি বেঙ্গল গ্লোবাল বিজনেস সামিটের সময় ঘরোয়া চায়ের আড্ডায় সেটা বহু চোখের সামনে হয়েছে। অনেকেই জানেন সে কথা। তা হলে?

দলেরই এক পক্ষের মত, এই সফরে ভাইপো আর মুকুলের মধ্যে সম্মানজনক সেতুবন্ধন করিয়ে দিতে চাইছেন মুখ্যমন্ত্রী। সে জন্য এক জনের ব্যবধানে বসানো হয়েছে দু’জনকে।

কিন্তু সেই ব্যবধান কমার কোনও চিহ্ন বৃহস্পতিবার অন্তত কেউ দেখতে পেলেন না। বরং মুকুলের প্রত্যাবর্তনে অভিষেক যে খুব সন্তুষ্ট হতে পারেননি, তৃণমূলের অন্দরে চলা সেই জল্পনাই আবার নতুন করে উস্কে উঠল। দিল্লিতে যে দিন মুকুলকে নৈশভোজে ডাকলেন মমতা, সে রাতের কথাও বলছিলেন দলের কেউ কেউ। ঘটনাস্থল ছিল অভিষেকের দিল্লির বাড়ি। তৃণমূল সূত্রের খবর, সে দিন মুকুলের মুখোমুখি হতে তাঁকে আগের মতোই নমস্কার করেন অভিষেক। তার পরে চলে যান নিজের অফিস ঘরে। সেখানেই কাটান অনেকটা সময়।

এ দিনও একটা ব্যবধান রয়েই গেল দু’জনের মধ্যে। মুকুল যেন কিছুটা পিছিয়েই রইলেন অনেক ক্ষেত্রে। যেমন, সাফারি পার্কের উদ্বোধন। ফিতে কাটার সময় মমতার এক পাশে অভিষেক, অন্য পাশে অরূপ। যেমন, জঙ্গল সাফারিতে। বন দফতরের একই গাড়িতে চেপে সাড়ে সাত কিলোমিটার ঘোরার সময় মমতার থেকে অনেকটাই পিছনে বসেন মুকুল। যেমন, সাফারি শেষে গাড়িতে ওঠার সময়। এগিয়ে দিতে এলেন সেই অভিষেক। কথা বললেন গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে।

শুধু এক বারই মুকুলকে কথা বলতে দেখা গিয়েছে মমতার সঙ্গে। বলছিলেন, সাফারি পার্কটি ভাল হয়েছে! শুনে হেসেছেন মুখ্যমন্ত্রী।

রাতে দার্জিলিঙের রিচমন্ড হিলের অতিথি নিবাসে ওঠেন মুখ্যমন্ত্রী। মুকুল তাঁর দলেরই সঙ্গী। লাটাগুড়ি চলে যান অভিষেক। শুক্রবার যাবেন দার্জিলিং। তার পরে কি কোনও ভাবে কাটবে শৈত্য? টান টান উত্তেজনায় তৃণমূলেরই অন্দরমহল।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement