সহজে ফুরিয়ে যাবেন না, বোঝালেন ‘নিঃসঙ্গ’ মুকুল

বিধ্বস্ত। হতাশ। তবু মচকাচ্ছেন না তৃণমূলের সদ্য প্রাক্তন সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়। পদের আগে ‘প্রাক্তন’ শব্দটি জুড়েছে মিনিট দশেক আগে। দল প্রতিষ্ঠার সময় থেকে যে মুকুল রায় তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক ছিলেন, আজ তাঁকে সেই পদ থেকে সরিয়ে দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কালীঘাটে শনিবার তৃণমূলের কার্যকরী কমিটির বৈঠকে মমতা জানিয়ে দেন নতুন কর্মসমিতি গঠন করা হচ্ছে এবং মুকুলের জায়গায় একক ভাবে দলের নতুন সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক হচ্ছেন সুব্রত বক্সী।

Advertisement

অগ্নি রায় ও সঞ্জয় সিংহ

নয়াদিল্লি ও কলকাতা শেষ আপডেট: ০১ মার্চ ২০১৫ ০৩:২২
Share:

দিল্লিতে সাউথ অ্যাভিনিউয়ের বাসভবনের বাইরে মুকুল রায়। শনিবার ইয়াসির ইকবালের তোলা ছবি।

বিধ্বস্ত। হতাশ। তবু মচকাচ্ছেন না তৃণমূলের সদ্য প্রাক্তন সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়।

Advertisement

পদের আগে ‘প্রাক্তন’ শব্দটি জুড়েছে মিনিট দশেক আগে। দল প্রতিষ্ঠার সময় থেকে যে মুকুল রায় তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক ছিলেন, আজ তাঁকে সেই পদ থেকে সরিয়ে দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কালীঘাটে শনিবার তৃণমূলের কার্যকরী কমিটির বৈঠকে মমতা জানিয়ে দেন নতুন কর্মসমিতি গঠন করা হচ্ছে এবং মুকুলের জায়গায় একক ভাবে দলের নতুন সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক হচ্ছেন সুব্রত বক্সী।

১৪১ সাউথ অ্যাভিনিউয়ের ড্রয়িংরুমে নিঃসঙ্গ মুকুল টিভির চ্যানেল বদল করে করে দেখেছেন তাঁর শেষ ডানাটিরও ছাঁটাইয়ের এই পর্বটি। তাঁকে ঘিরে রয়েছে গাঢ় ধোঁয়ার বলয়। কারণ আজ নিভছেই না সিগারেট! কলকাতায় পার্থ চট্টোপাধ্যায়দের সাংবাদিক সম্মেলন আগাগোড়া দেখার পরে নিজেকে সামলাতে সামান্য সময় নিলেন। তার পরই বেরিয়ে সংলগ্ন লনে এসে যথাসাধ্য নিরুত্তাপ গলায় জানালেন, দলনেত্রীর সিদ্ধান্তই এ ক্ষেত্রে শেষ কথা। মমতা চাইলে তৃণমূলের নতুন ওয়ার্কিং কমিটি তৈরি করতেই পারেন। এ ব্যাপারে তাঁর কোনও প্রতিক্রিয়া নেই। পাশাপাশি আরও একটি কথা বলছেন আহত মুকুল “এত সহজে ফুরিয়ে যাওয়ার মানুষ আমি নই!”

Advertisement

ফুরিয়ে যেতে নারাজ মুকুল নতুন করে প্রস্তুত হচ্ছেন। দল তাঁকে সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার পরেই সংসদের হাউস কমিটিকে চিঠি দিয়ে তাঁর নামে বরাদ্দ বাংলো ছাড়তে চাইলেন তিনি। মুকুলের কথায়, “আমি চিঠি দিয়েছি সংসদীয় হাউস কমিটিকে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দিল্লি এলে ১৮১ নম্বর বাংলোয় থাকতেন। উনি যখন থাকছেন না, তখন ওটা আমার নামে রাখার কোনও মানে হয় না। ১৪১ নম্বর বাংলোটাও রাখার মানে নেই। আমি যে হেতু প্রাক্তন পূর্ণ মন্ত্রী, তাই টাইপ-৮ বাংলো পেতে পারি। আমি সেই মর্মে আবেদন করেছি।”

মুকুলের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব বৃদ্ধির পরেই দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের ডানা ছাঁটার কাজ শুরু করেছিলেন মমতা। সপ্তাহ দুয়েক আগে মুকুলের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছিল নেত্রীর আস্থাভাজন সুব্রত বক্সীকে। রাজ্যসভার দলীয় নেতার পদ থেকেও মুকুলকে সরিয়ে সেই পদে আনা হয় ডেরেক ও’ব্রায়েনকে। এ দিন মুকুলকে সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকেই সরিয়ে দেওয়া হল। ক’দিন আগেও যে মুকুল ছিলেন দলনেত্রীর প্রধান সেনাপতি, দলের নম্বর-টু, এখন তিনি শুধুই এক জন তৃণমূল সাংসদ!

মুকুলকে সরানোর একটা ব্যাখ্যা এ দিন কালীঘাটের বৈঠকে দিয়েছেন মমতা। দলীয় এক সূত্রে জানা গিয়েছে, বেশ কিছু দিন ধরে মুকুল দলের কাজে সময় দিতে পারছেন না বলে দলীয় বৈঠকে জানান মমতা। মুকুলের কাজের প্রশংসার মোড়কে এ দিন মমতা

বুঝিয়ে দিয়েছেন, দলের একদা সেনাপতির কাজে তিনি সন্তুষ্ট নন। তিনি বৈঠকে বলেন, “মুকুল আগে ভাল কাজ করত। খুবই এফেক্টিভ ছিল। এখন ব্যক্তিগত কাজে ব্যস্ত বলে সময় দিতে পারছে না।” দলনেত্রী জানান, এ দিনের বৈঠকে থাকার জন্য মুকুলকে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ব্যক্তিগত কাজে ব্যস্ত থাকায় তাঁর পক্ষে বৈঠকে থাকা সম্ভব হবে না বলে মুকুল দলীয় নেতৃত্বকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছিলেন।

কয়েক দিন ধরে শীর্ষ নেতৃত্বের পক্ষ থেকে যে ভাবে তাঁকে কোণঠাসা করা হচ্ছিল, তাতে সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের পদটি যে আর বেশি দিন নেই, তা জানতেন মুকুল। তাই দিল্লিতে যথাসাধ্য ঘুঁটি সাজানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন তিনি, কিছুটা মরিয়া হয়েই। নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে। তবে আজ, সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে শুধু নয়, দলের ওয়ার্কিং কমিটি থেকেও ছিটকে যাওয়ার পর দৃশ্যতই আবেগতাড়িত তিনি। তুলে ধরলেন ১৮ বছর আগে তৃণমূল গঠনের সেই দিনটির কথা, যখন দলের একমাত্র সাধারণ সম্পাদক হিসেবে মমতার প্রাথমিক সদস্যপদের আবেদনটি নির্বাচন কমিশনে জমা দিয়েছিলেন। তাঁর কথায়, “এখন তৃণমূলের রাজ্যসভায় ১১ এবং লোকসভায় ৩৪ জন সাংসদ। দল এখন পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় এসেছে। অসম, মনিপুরে তৃণমূলের বিধায়ক রয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গের বেশির ভাগ পঞ্চায়েত এবং জেলা পরিষদ দলের সঙ্গে রয়েছে। আর এই দল যখন শূন্য ছিল, তখন একমাত্র জেনারেল সেক্রেটারি হিসেবে কাজ করেছি আমি। দল তৈরি করে যখন প্রথম নির্বাচন কমিশনের কাছে দরখাস্ত দিয়েছিলাম, দলনেত্রী তখন তার সদস্য ছিলেন না।” আবেগজড়ানো গলায় মুকুল বলেন, “আজ ভাবতে গর্ব হয়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রাথমিক সদস্যপদের আবেদনপত্র হলফনামা-সহ আমি জমা দিয়েছিলাম নির্বাচন কমিশনে।”

তবে আবেগ দিয়ে যে রাজনীতির চিঁড়ে ভেজে না, সেটা ভালই জানেন এই পোড় খাওয়া নেতা। জানেন যে, তাঁর সামনের পথ কঠিন। বিজেপির সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলছেন ঠিকই, কিন্তু এখনই তাঁকে দলে নিতে চাইছে না তারা। রাজনৈতিক সূত্রের খবর, এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে সারদা তদন্তের প্রাথমিক পর্যায়ের তদন্তের কাজ অনেকটা গুটিয়ে আনবে সিবিআই। তার পরেই পশ্চিমবঙ্গের ৯০টিরও বেশি পুরসভার ভোট। যদি দেখা যায়, মুকুল রায়কে ‘ক্লিনচিট’ দিচ্ছে সিবিআই, তখন তাঁকে নেওয়ার কথা ভাববে বিজেপি। ইতিমধ্যে মুকুল তৃণমূলের ভিতরে থেকে দলকে কতটা ভাঙতে সফল হন, সে দিকে নজর রাখবে বিজেপি। কাজটি সহজ নয় মুকুলের পক্ষে। দলে তিনি ব্রাত্য, বিজেপিতেও তাঁর আশু যোগ দেওয়ার সম্ভাবনা নেই। ফলে যত সময় যাবে, ততই দলকে গুছিয়ে নেওয়ার সুযোগ পাবেন মমতা। অন্য দিকে, চূড়ান্ত অপমানিত হলেও মুকুল এখনও স্থির করে উঠতে পারছেন না যে, কবে দল ছাড়বেন। তবে পদত্যাগের আগে তিনি যে একটি সাংবাদিক বৈঠক করবেন এবং মমতাকে দীর্ঘ চিঠি লিখবেন, সে ব্যাপারে আজ ইঙ্গিত দেন মুকুল। ওই সঙ্গে দেওয়া হবে বহু পুরনো তথ্য ও নথি, যার একটি হল মমতার তৃণমূলের প্রাথমিক সদস্যপদের আবেদনপত্র। যেটি মুকুল ১৯৯৭-এর ২৪ ডিসেম্বর নিয়ে গিয়েছিলেন নির্বাচন কমিশনে।

বিজেপি নেতৃত্ব চান, খোলাখুলি ভাবে মমতার বিরোধিতা করে মাঠে নামুন মুকুল। সেটি এখনও না করলেও আজ অরুণ জেটলির বাজেটের প্রশংসা করেছেন মুকুল। বৃহস্পতিবারের রেল বাজেট নিয়ে এতটা উচ্ছ্বসিত হননি তিনি। আজ সকালে বাজেট শুনতে গ্যালারিতে ছিলেন মুকুল। সামনের সারিতেই বসেছিলেন তাঁকে টপকে তৃণমূলের রাজ্যসভার নেতার পদ পাওয়া ডেরেক ও’ব্রায়েন। বাক্য বিনিময় দূরস্থান, শুভেচ্ছা বিনিময়ও হয়নি দু’জনের! বাজেট নিয়েও দুই নেতা সম্পূর্ণ দুই মেরুর মতামত দিয়েছেন। ডেরেক যখন বাজেটে পশ্চিমবঙ্গের আর্থিক প্যাকেজকে ‘বিশ্বকর্মা পুজোর চাঁদা’ বলে অবজ্ঞা করছেন, তখন মুকুলের মতে এই বাজেট পশ্চিমবঙ্গের জন্য ‘অত্যন্ত ভাল খবর’। তাঁর কথায়, “দেশের রাজস্বের ৬২ শতাংশ রাজ্যগুলির জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে, এটা খুবই ভাল পদক্ষেপ। এর ফলে নিশ্চিত ভাবেই রাজ্যের আয় বাড়বে। বাংলাকে যে প্যাকেজ দেওয়া হয়েছে, তাকেও স্বাগত জানাচ্ছি।”

যে তৃণমূলে মমতার পরে তিনিই ছিলেন সর্বেসর্বা, আজ তাঁকে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক করে দেওয়া হল। নিঃসঙ্গ লাগছে না? মুখের ছবিতেই উত্তরটা স্পষ্ট। তবু মচকাচ্ছেন না মুকুল! বললেন, “প্রতি মুহূর্তে রাজ্যের বিভিন্ন নেতা-কর্মী-মানুষের ফোন পাচ্ছি। কোনও কমিটিতে আছি কি নেই, তার উপর কিছু নির্ভর করে না। করে মানুষের সমর্থনের উপর। আমার সঙ্গে মানুষ রয়েছেন।” কিন্তু এটা স্পষ্ট যে দল তাঁর সঙ্গে নেই? মুকুলের মন্তব্য, “একটি ঘটনা ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে তার ব্যাখ্যা হয় না। একটু সময় যাক, তার পরেই বোঝা যাবে যে, এই সিদ্ধান্ত সঠিক না ভুল।”

প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ তাঁর শেষ সাংবাদিক সম্মেলনে একটি প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছিলেন। জানতে চাওয়া হয়েছিল, কী ভাবে তিনি ফিরে দেখতে চান তাঁর শাসনকালকে? মনমোহনের উত্তর ছিল, ইতিহাসই বিচার করবে। আজ তৃণমূলে মুকুল-ঝরার উঠে এল সেই প্রসঙ্গ। তৃণমূলের সদ্যপ্রাক্তন প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদকের কথায়, “মনমোহন সিংহের বয়স হয়েছে, উনি অসুস্থও। তিনি জানতেন যে দল জিতলেও তিনি আর প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। তাই ক্ষমতায় থাকতে ইতিহাসের প্রসঙ্গ টেনেছিলেন। মনে রাখবেন, আমি কিন্তু এখনই অত সহজে ফুরিয়ে যাওয়ার লোক নই!”

সাউথ অ্যাভিনিউ থেকে পাঠানো এই বার্তা কালীঘাটে পৌঁছল কি?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement