সাত দিন আগে কলকাতার পুরভোটে তবু তাঁর দেখা পাওয়া গিয়েছিল। তপসিয়ায় তৃণমূল ভবনের অদূরে ভোট দিতে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু শনিবার রাজ্যের ৯১টি পুরসভার ভোটে তিনি অন্তরালেই রইলেন। এমনকী ভোট চলাকালীন তাঁর আদি নিবাস উত্তর ২৪ পরগনার কাঁচরাপাড়ার বাড়িতেও ছিলেন না। তাঁর বিধায়ক পুত্র সেখানকার ভোটে প্রার্থী হলেও, ভোট যুদ্ধে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রাক্তন ‘সেনাপতি’ মুকুল রায় এ দিন কার্যত আত্মগোপন করে রইলেন কলকাতায় তাঁর গোপন ডেরায়।
কেন এই গোপনীয়তা, তা নিয়ে মুখ খোলেননি মুকুল। জোরাজুরি করলে বলেছেন, ‘‘না, আজ কোনও কথা নয়।’’ গোপন ডেরায় বসে তাহলে কী করলেন তিনি? টেলিফোনে মুকুলের জবাব, ‘‘ভোট কেমন হচ্ছে, টিভিতে দেখছিলাম।’’ কেমন ভোট হল? আবার নেতিবাচক মুকুল। বললেন, ‘‘না, বললাম তো আজ কিছু বলব না। আজকে ভোট নিয়ে কোনও কথা নয়। আমাকে এ নিয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করে বিব্রত করবেন না প্লিজ।’’ তবে তাঁর ঘনিষ্ঠ জনেদের কারও কারও বক্তব্য, ‘‘যে ভাবে ভোট হয়েছে, তা দাদা একেবারেই পছন্দ করেননি।’’ একদা দলনেত্রীর সঙ্গে আলোচনা করেই তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল ভোট যুদ্ধের যাবতীয় ঝড়-ঝাপটা সামলাতেন। দলনেত্রীর সঙ্গে দূরত্ব বাড়ার পরে, যেমন পদ খুইয়েছেন, তেমনই পুরভোটের প্রচারেও মুকুলকে শত হস্ত দূরেই রেখেছেন মমতা।
ভোট যুদ্ধে মুকুলকে সামিল না করে মমতা সেই দায়িত্ব দলের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে বন্টন করে দিয়েছিলেন। সেই নেতারা মুকুল ‘বিকল্প’ হওয়ার লক্ষ্যে কোনও ঝুঁকি নেননি। দলের এক নেতার কথায়, ‘‘জয় নিশ্চিত করতে ওই নেতারা যা করণীয়, করেছেন। তবে মুকুল দায়িত্বে থাকলে মসৃণ ভাবে কাজ হাসিল করতেন। বাইরে থেকে কেউ টেরই পেত না তিনি কী কৌশল নিয়েছেন!’’
তবে কলকাতা পুরভোটের পর, এ দিনও রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় শাসক দলের নেতা-কর্মীদের আগ্রাসী আচরণ তৃণমূলকে বেআব্রু করে দিয়েছে বলে মুকুল-অনুগামীদের অনেকেরই অভিমত। মুকুল-ঘনিষ্ঠ এক নেতার কথায়, ‘‘ভোট তো হল। এ বার ফল বেরোলে বোর্ড গঠন নিয়েই নিজেদের মধ্যে গোলমাল আরও পাকবে। আগে তো দাদা সব সামলে দিতেন।’’ মুকুল অবশ্য এ সব নিয়ে মুখ খুলতে চাননি।
মুকুল-ঘনিষ্ঠ ব্যারাকপুরের বিধায়ক শীলভদ্র দত্ত অবশ্য দলের নেতাদের মতোই জানিয়েছেন, দু’একটি বিক্ষিপ্ত ঘটনা ছাড়া ভোট শান্তিতেই হয়েছে। আর ভোট-পরবর্তী পরিস্থিতি দলীয় নেতৃত্ব সামলাতে পারবেন। মুকুল-পুত্র শুভ্রাংশু অবশ্য বাবাকে ছাড়াই নিজের এলাকায় ভোট সামলান। তাঁর বাবা জানিয়েছেন, আজ, রবিবার বিকেলেই তিনি দিল্লি চলে যাবেন।
আগে ভোট যুদ্ধে তপসিয়ায় তৃণমূল ভবনের একতলার বাঁদিকে ‘ওয়াররুমে’ মুকুলকে যে ভূমিকায় দেখা যেত, এ দিন সেই জায়গায় ‘কন্ট্রোলরুম’ থেকে পালা করে দায়িত্ব সামলেছেন দলের বর্তমান সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক সুব্রত বক্সী, মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়, মন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়, বিধানসভার সরকারি মুখ্যসচেতক শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়, মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়, দুই মেয়র পারিষদ অতীন ঘোষ, স্বরূপ ঘোষ প্রমুখ। গত শনিবার কলকাতায় পুরভোটে কন্ট্রোলরুমের যে ছবি ছিল, এ দিনও মোটামুটি তারই প্রতিবিম্ব দেখা গিয়েছে। দলীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, মাঝে মধ্যেই কাটোয়া, শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি, ব্যারাকপুর বা রাজ্যের কোথাও কোনও সমস্যা হলেই নানা জায়গা থেকে দলীয় কর্মী-নেতাদের ফোন এসেছে কন্ট্রোলরুমে। পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য পার্থবাবুরা তাঁদের প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়েছেন।
ভূমিকম্পের সময়েও পার্থবাবুরা কন্ট্রোলরুম ছেড়ে বাইরে বেরোননি। ভূমিকম্পে চেয়ার নড়ে ওঠায় শোভনদেববাবু ভেবেছিলেন, তাঁর মাথা ঘুরছে। আর পার্থবাবুর চেয়ারটা নড়ায় ভেবেছিলেন তাঁর ‘বন্ধু’ বক্সী বোধহয় ঠেলা মারছেন। মুহূর্তে ভুল ভাঙে। কিন্তু একতলায় ঘরে বসে থাকায় কেউ আর বাইরে বেরোননি।
হেলায় ভোট হয়ে যাচ্ছে যখন তখন বাইরে বেরোনোর দরকার কী!