কলকাতা বিমানবন্দরে মুকুল রায়। সোমবার। —নিজস্ব চিত্র
আগের দিন কালীঘাট পাড়া এড়িয়ে গিয়েছিলেন। তার পর দিনই নবান্নে গিয়ে একান্তে কথা বলে এলেন দলনেত্রীর সঙ্গে। সেখান থেকে বেরিয়ে আবার আর এক বিক্ষুব্ধ নেতা সব্যসাচী দত্তকে সঙ্গে নিয়ে দিল্লির পথে!
তৃণমূলে মুকুল-রহস্য চলছেই! বলা যেতে পারে, নাটকীয় নানা মোচড় অব্যাহত। কখনও দলের সর্বময় নেত্রীর সঙ্গে সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের দূরত্ব প্রকট, কখনও আবার দূরত্ব ঘোচানোর বার্তা দেওয়ার চেষ্টা! নাটকীয় ঘাত-প্রতিঘাতের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই মুুকুল রায় কখনও বলছেন সারদা-তদন্তে সিবিআইয়ের সঙ্গে পূর্ণ সহযোগিতা করবেন, কখনও বলছেন সিবিআই নিয়ে কোনও প্রশ্নের জবাব দেবেন না! কাণ্ড দেখে আলোড়ন চলছে শাসক দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে!
নিজাম প্যালেসে নিজের অনুগামীদের সঙ্গে কথা বলে এবং ইডেনে খানিকক্ষণ রঞ্জি ট্রফির ক্রিকেট ম্যাচ দেখে রবিবারটা কাটিয়েছিলেন মুকুল রায়। তাঁর সোমবার দিল্লি-যাত্রা পূর্ব নির্ধারিতই ছিল। তার আগে এ দিন দুপুর সাড়ে ১২টা নাগাদ নবান্নে হাজির হন মুকুল। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘরে প্রায় ৪০ মিনিট একান্তে কাটিয়ে নবান্ন ছাড়ার সময়ে অবশ্য মুখ থমথমেই দেখিয়েছে প্রাক্তন রেলমন্ত্রীর। কিন্তু চলতি পরিস্থিতিতে মুকুলের সশরীর নবান্নে গিয়ে তৃণমূল নেত্রীর সঙ্গে দেখা করা মানেই দূরত্ব ঘোচানোর জল্পনা শুরু হতে বাধ্য! তৃণমূলেরই একাংশ অবশ্য বলছে, খেলা অত সহজ নয়! কেউ কেউ বলছেন, মুকুল-মমতা টানাপড়েন এখন যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, এক বার দেখা হওয়া বা একটা বৈঠকের মধ্যেই তার নিরসন সম্ভব নয়। এ যেন অনেকটা ম্যাগনাস কার্লসেনের সঙ্গে বিশ্বনাথন আনন্দের বিশ্ব দাবা চ্যাম্পিয়নশিপের লড়াই চলছে! দু’পক্ষই চাল দিচ্ছেন একে অপরকে ভাল করে মেপে নিয়ে, সময় নিয়ে। দু’পক্ষই জানেন, একটা ভুল চাল মানেই স্নায়ুযুদ্ধে পিছিয়ে পড়া!
মুুকুল-মমতা বৈঠকের মধ্যে দিয়ে যখন অন্য রকম বার্তা দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে, সেই দিনই আবার দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদককে নিয়ে বিরোধীদের আক্রমণের জবাব দিতে অস্বীকার করে রহস্যে নতুন মাত্রা জুড়েছেন তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়! বিরোধীদের সামান্য সমালোচনা শুনলেও যাঁরা তীব্র আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়েন, সেই দলেরই মহাসচিব জানিয়ে দিয়েছেন মুকুলকে নিয়ে মন্তব্যের জবাব মুকুলই দেবেন! যা দেখিয়ে দিচ্ছে, মুকুলকে নিয়ে স্নায়ুযুদ্ধ পুরোদস্তুর বহাল!
তৃণমূলের একটি সূত্রের খবর, মমতা এবং মুকুল, দু’জনেই উপলব্ধি করেছেন তাঁদের সম্পর্ক নিয়ে যে স্তরের জল্পনা চলছে এবং তাঁরা নিজেরাও যে ধরনের বার্তা দিচ্ছেন, তাতে দু’জনেরই ক্ষতি হচ্ছে। তাই দিল্লি যাওয়ার আগে নবান্নে মুখোমুখি বসে মমতা-মুকুলের এক দফা আপস-রফার চেষ্টা হয়েছে। তৃণমূল নেত্রী দলে তাঁর এক সময়ের ডান হাতকে অনুরোধ করেছেন, প্রকাশ্যে মুখ খোলার সময় দলের ‘সম্মানে’র কথা একটু খেয়াল রাখতে। অনুরোধ একেবারে ফেলে দেননি মুকুলও। সম্ভবত সেই কারণেই এ দিন দিল্লি যাওয়ার সময় কলকাতা বিমানবন্দরে ইঙ্গিতপূর্ণ কোনও মন্তব্য থেকে বিরত থেকেছেন রাজ্যসভার এই সাংসদ।
বিমানবন্দরে এ দিন সংবাদমাধ্যমকে দেখেই মুকুল একনাগাড়ে বলতে থাকেন, “কোনও প্রশ্ন নেব না!” বলেন, সারদা বা সিবিআই নিয়ে নতুন করে তাঁর কিছু বলার নেই। নিজেই জানান, সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে যোগ দিতে দিল্লি যাচ্ছেন। আজ, মঙ্গলবার সেই বৈঠক। বুধবার সুপ্রিম কোর্টে সিবিআই তদন্ত নিয়ে তৃণমূলের দায়ের করা মামলারও শুনানি হওয়ার কথা। দিল্লি যাওয়ার সেটাও অন্যতম কারণ। এইটুকু তথ্য দিয়েই মুখ বন্ধ করে নিয়েছেন মুকুল। কিন্তু তাঁর দিল্লি-যাত্রার সঙ্গী-চয়ন আবার নতুন করে জল্পনার জন্ম দিয়েছে! সারদা তদন্ত নিয়েই ক’দিন আগে বেসুর গেয়ে দলনেত্রীর উষ্মা বাড়িয়েছিলেন বিধায়ক সব্যসাচী। মমতা অবশ্য মুকুল-অনুগামী এই বিধায়ককে তিরস্কারের বদলে অন্য নেতাদের সঙ্গে বনগাঁ উপনির্বাচনে প্রচারের দায়িত্ব দিয়েছেন। অথচ তার পরেও সব্যসাচীকে নিয়ে মুকুল দিল্লি যাওয়ায় দলেরই এক নেতার মন্তব্য, “সব সময়ই মনে হচ্ছে, কোনও চিত্রনাট্য মেনে কাজ এগোচ্ছে!”
এমন সব জল্পনাতেই নতুন ইন্ধন জুগিয়েছেন পার্থবাবু। মুকুলের সঙ্গে মমতার দূরত্বের জেরে তৃণমূল আড়াআড়ি ভেঙে যেতে পারে বলে মন্তব্য করেছিলেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী। এই প্রসঙ্গ টেনে এ দিনই অধীর বলেন, “মুকুলকে ট্রয় নগরীর ঘোড়ার মতো ব্যবহার করে বিজেপি তৃণমূলকে ভাঙতে চাইছে!” অর্থাৎ দলের ভিতর থেকে দলকে ভাঙতে কাজে লাগানো হচ্ছে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদককে! এই বিষয়ে পার্থবাবুর প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, “যাঁকে (মুকুল) অধীরবাবু বলেছেন, তিনিই উত্তর দেবেন! দলকে তো বলেননি! মুকুলবাবু যথেষ্ট যোগ্য, তিনি উত্তর দিতে পারবেন। আমাদের সাধারণ সম্পাদক যখন সর্বভারতীয়, তিনিই জবাব দেবেন!” তপসিয়ায় তৃণমূল ভবনে পার্থবাবুর পাশেই বসেছিলেন দলের রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সী। তিনিও কোনও মন্তব্য করেননি। পার্থবাবুর মন্তব্যে তৃণমূলের অন্দরে অনেকেই বিস্মিত! চর্চা হচ্ছে, তা হলে কি মুকুলের হয়ে দলীয় স্তরে জবাব দেওয়ার ‘দায়িত্ব’ কাঁধে নিতে চাইছেন না তৃণমূল নেতারা? মুকুল এর মধ্যে একাধিক বার বলেছেন, সিবিআই নিয়ে তিনি নিজের কথা বলছেন, দল তাদের অবস্থান জানাচ্ছে। প্রশ্ন উঠেছে, এ বার কি পার্থবাবুরাও বুঝিয়ে দিলেন, দল আর মুকুল আলাদা?
শাসক দলের মুকুল-কাণ্ড দেখে অবশ্য প্রশ্ন তুলতে ছাড়ছে না বিরোধীরা। বাগদায় উপনির্বাচনের কর্মিসভায় গিয়ে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসুর প্রশ্ন, “উনি (মুকুল) তো তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক। ওঁর কোনও কথা ব্যক্তিগত হয় কী করে? এর জবাব কে দেবে?” আর স্বরূপনগরে গিয়ে বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্য কটাক্ষ করেছেন, “দিদি এখন গভীর চিন্তায়। আতঙ্কে মাঝে মাঝে রাতে ঘুম ভেঙে যাচ্ছে! যেখানে চোর ধরা উচিত, সেখানে জনগণের করের টাকা খরচ করে সারদা নিয়ে সিবিআই তদন্ত বন্ধ করতে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করেছে। অপরাধ ঢাকতে চাইছে!”
তৃণমূলের সঙ্কট বা ভাঙন অধীরের দাবিকে অবশ্য উড়িয়ে দিয়েছেন পার্থবাবু। সেই সঙ্গেই বিপর্যস্ত দলকে চাঙ্গা করতে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের ‘জন-বিরোধী অধ্যাদেশে’র বিরুদ্ধে পথে নামার কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। জমি অধিগ্রহণ থেকে শুরু করে কয়লা, বিমা, পেনশন ইত্যাদি বিষয় সংক্রান্ত অধ্যাদেশ বাতিলের দাবিতে আগামী ৭-৮ ফেব্রুয়ারি এবং ১৪-১৫ ফেব্রুয়ারি বিকেল ৩টে থেকে এক ঘণ্টার জন্য রাজ্যে সমস্ত ব্লক থেকে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে তৃণমূল মিছিল করবে। পার্থবাবু বলেন, “সংসদকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দেশকে বেচার যে পরিকল্পনা করছে বিজেপি-র সরকার, তার প্রতিবাদেই আমরা পথে নামছি। মানুষের কোনও অসুবিধা না করে প্রতিবাদ মিছিল করা হবে।” কলকাতায় কেন্দ্রীয় ভাবে মিছিল হলে তৃণমূল নেত্রী কি তাতে অংশ নেবেন? পার্থবাবুর জবাব, “আগে তো আমরা নামি। তার পরে স্ট্রাইকার নামবে!”