সাদা জামা পরা মুকুল রায় অবশ্য মুম্বই থেকে এসে পৌঁছলেন ধর্না উঠে যাওয়ার পরে। মঙ্গলবার রাজেশ কুমারের তোলা ছবি।
সংসদের বাইরে তখন যেন সবুজের মেলা! কেন্দ্রের জমি অর্ডিন্যান্সের বিরোধিতায় তৃণমূলের এক ঝাঁক সাংসদ আগাগোড়া সবুজ সাজে সজ্জিত হয়ে বসেছেন ধর্নায়! কিন্তু সেই আসরে নেই মুকুল রায়! গত কয়েক দিন ধরে দলের অন্দরে ক্রমশ কোণঠাসা হয়ে পড়া মুকুলের অনুপস্থিতি নিয়ে মৃদু গুঞ্জনও উঠল ভিড়ের মধ্যে। কিন্তু ওই টুকুই! দলের সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান তথা রাজ্যসভার নেতাকে বাদ দিয়েই দিব্যি ধর্না চালিয়ে গেলেন তৃণমূলের সাংসদরা।
নিঃসঙ্গ মুকুল তখন ব্যস্ত অন্য ধর্নায়! সংসদ থেকে চোদ্দোশো কিলোমিটার দূরে, মুম্বইয়ে সিদ্ধি বিনায়ক মন্দিরে। সেখান থেকে পুজো দিয়ে তিনি যখন সংসদে এলেন, তত ক্ষণে ধর্না উঠে গিয়েছে!
তৃণমূলের অন্দরে মুকুলের একা হয়ে যাওয়ার তখনও কিছুটা বাকি ছিল! বৃত্ত সম্পূর্ণ হল সংসদে তৃণমূলের রণনীতি ঠিক করতে গড়া নতুন কমিটির কথা জানাজানি হওয়ার পরে। যেখানে ঠাঁই হয়নি দলের সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যানেরই! সংসদীয় রণকৌশলের গুরুদায়িত্ব থেকে তাঁকে দূরে সরিয়ে রাখল দল।
সংসদীয় কৌশল ঠিক করতে এ দিন তৃণমূলের যে ছয় সদস্যের কমিটি গড়া হয়েছে, তাতে লোকসভার সাংসদদের মধ্যে রয়েছেন সৌগত রায়, কাকলি ঘোষদস্তিদার, কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও সুলতান আহমেদ। রাজ্যসভা থেকে কমিটিতে রয়েছেন ডেরেক ও’ব্রায়েন ও সুখেন্দুশেখর রায়। এই ছ’জন ছাড়াও কমিটিতে অতিথি সদস্য হিসেবে রয়েছেন তৃণমূলের তিন লোকসভার সাংসদ শুভেন্দু অধিকারী, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ও সুব্রত বক্সী। তৃণমূল নেতৃত্বের বক্তব্য, প্রতিদিন সংসদের কাজ শেষ হলে সারা দিনের মূল্যায়ন ও আগামী দিনের রণকৌশল ঠিক করতে বৈঠকে বসবে ওই কমিটি। বৈঠক হবে ডেরেক ও সৌগত রায়ের বাড়িতে। পর্যায়ক্রমে, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। দলীয় সূত্রের খবর, শেষ তিন জন দলের কাজে ব্যস্ত থাকায় সংসদ চলাকালীন সব সময়ে দিল্লিতে থাকতে পারেন না। তাই তাঁদের অতিথি সদস্য হিসেবে রাখা হয়েছে। দলীয় নেতৃত্ব জানিয়েছে, দিল্লিতে থাকলে এঁরা দলীয় বৈঠকে যোগ দেবেন।
এ ভাবেই কোণঠাসা হয়ে পড়া মুকুল রায়কে ক্রমশ খাদের কিনারে নিয়ে যেতে তৎপর হয়ে উঠেছেন তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব। মুকুল অবশ্য এর পরেও যথেষ্ট সংযমী থেকেছেন। এ দিন মুম্বই থেকে ফিরে আচমকাই তিনি চলে আসেন রাজ্যসভায়। সেখানে কিছু ক্ষণ থেকে চলে যান। রাজ্যসভায় জমি অর্ডিন্যান্স নিয়ে ভোটাভুটি হতে পারে বলে আশঙ্কা ছিল তৃণমূলের। তাই সাংসদদের উপস্থিত থাকার জন্য হুইপ জারি করেছিল তারা। মুকুলবাবুকে সে কথা আলাদা করে বলা হয়নি, কিন্তু দলের বিরোধী শিবিরকে কার্যত হতচকিত করে ঠিক সময়ে সংসদে উপস্থিত হয়ে যান তিনি। কেন না, মুকুল জানেন, তিনি অনুপস্থিত থাকলে ভবিষ্যতে দলবিরোধী কাজ করেছেন, এই যুক্তিতে হয়তো তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেন দলীয় নেতৃত্ব। তাই নিজস্ব সূত্রে হুইপের কথা জানতে পেরে বেলার দিকে সংসদে আসেন তিনি!
জমি অর্ডিন্যান্সের বিরোধিতায় সংসদে তৃণমূলের ধর্নায় নেত্রীর নির্দেশমাফিক
সবুজ পোশাকে তাপস পাল ও শতাব্দী রায়। মঙ্গলবার প্রেম সিংহর তোলা ছবি।
জমি অর্ডিন্যান্সের বিরোধিতা করতে ধর্নায় বসার জন্য তৃণমূল সাংসদরা এ দিন প্রায় সকলেই সবুজ পোশাক পরে এসেছিলেন। সোমবার সন্ধেয় কলকাতা থেকে নেত্রীর নির্দেশ এসেছিল দিল্লিতে মাঠঘাট, খেতখামারের রং সবুজ। তাই জমি অর্ডিন্যান্স নিয়ে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করতে নিজেদের সাজিয়ে তুলতে হবে সবুজে সবুজে!
নেত্রীর নির্দেশ বলে কথা! মঙ্গলবার সকালে ধর্নার আগে শেষ মুহূর্তে হইচই পড়ে গিয়েছিল তৃণমূল সাংসদদের সাজঘরে। রত্না দে নাগ, কাকলি ঘোষ দস্তিদার, শতাব্দী রায়, সৌগত রায়, মুনমুন সেন, প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়, সৌমিত্র খান সব সাংসদই বাধ্য হয়ে নামেন সবুজের সন্ধানে! কাকলি ঘোষদস্তিদারের কথায়, “কৃষকদের পাশে দাঁড়িয়ে, সবুজ বিপ্লব যদি করতে হয়, তা হলে সবুজ পোশাক পরাটাই তো ভাল!”
তবে যুক্তি যত সহজে হাজির করা যায়, সবুজ পোশাক খুঁজে বের করাটা তার থেকে অনেক বেশি মুশকিলের! বিশেষত পুরুষ সাংসদদের ক্ষেত্রে। প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় তো কাল রাতেই দৌড়েছেন দোকানে। আজ দেখা গেল, শস্যশ্যামলা সবুজ না জুটলেও, টিয়াপাখি রঙা শার্ট পরে স্লোগান দিচ্ছেন এই প্রাক্তন ফুটবলার! যে সৌগত রায়কে সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি ছাড়া আদৌ দেখা যায় না সংসদে, সেই তিনিও আজ ধুতির উপরে সবুজ শার্ট চাপিয়ে ধর্নায় হাজির! পরে অবশ্য লোকসভায় ঢোকার আগে সবুজ জামা পাল্টে ফিরে গিয়েছেন সাদাতেই! শতাব্দী রায় জানালেন, “ওয়ার্ডরোব খুলেই সুবজ শাড়িটা ভাগ্যিস পেয়ে গেলাম!” তাঁর বহু ছবির নায়ক তাপস পালের ভাঁড়ারে অবশ্য সব সময়ই যে সবুজ শার্ট মজুত থাকে, তা লোকসভায় আগে অনেক বারই দেখা গিয়েছে। আজ তাই শতাব্দীর সবুজের সঙ্গে মিলে গিয়েছে তাপসের কুর্তার রঙ। তৃণমূলের ফ্যাশন আইকন মুনমুন সেন বললেন, “দলের নির্দেশে সবুজ শাড়ি পরেছি। যে ভাবে অন্যান্য দলের সঙ্গে কথা না-বলেই কেন্দ্র একের পর এক অর্ডিন্যান্স আনছে তা গণতন্ত্রবিরোধী। এর বিরুদ্ধেই আমাদের প্রতিবাদ।” তবে শেষ পর্যন্ত অনেকেরই সবুজ পাঞ্জাবি বা শার্ট জোগাড় হয়নি (যেমন অনুপম হাজরা)। তাঁরা সবুজ কাপড় গলায় জড়িয়েছেন।
ব্যতিক্রম শুধু মুকুল রায়। আগেই ঠিক করা ছিল, মুম্বইয়ে সিদ্ধি বিনায়ক মন্দিরে মঙ্গলবার সকালে পুজো দেবেন তিনি। সেই মতো কাল রাতেই মুম্বইয়ের উড়ান ধরেন নিঃসঙ্গ নেতা। কাউকে কিছু জানাননি। পুজো দিয়ে ফিরে আসেন দিল্লিতে। তবে নেত্রীর নির্দেশ মেনে দলের অন্যদের মতো সবুজ পোশাকে নয়!
এ দিন সাদা জামা পরা মুকুল সংসদে ঢোকার পরেই তাঁর দিকে চোখ চলে যায় বাকিদের। কিছু ক্ষণ আগে সবুজ পোশাক পরে ধর্নায় বসা তৃণমূল সাংসদদের উদ্দেশে ভিন্ দলের এক বাঙালি সাংসদ টিপ্পনি কাটেন, ‘বসন্ত এসে গেছে’! অন্য দিন হলে এ নিয়ে হইচই হতেই পারত। অস্বস্তি এড়াতে এ দিন রা কাড়েননি কেউ!
সবুজের সমাবেশে নিঃসঙ্গই রইলেন মুকুল!