শুভেন্দু অধিকারী, সুনীল মন্ডল এবং শীলভদ্র দত্ত। ফাইল চিত্র।
শুভেন্দু অধিকারী যে আর তৃণমূলের সঙ্গে থাকছেন না, তা মোটামুটি স্পষ্ট। যেমন এটাও কার্যত স্পষ্ট, যে তিনি বিজেপি-তে যোগ দিতে চলেছেন। জল্পনা— শুভেন্দু কবে এবং কখন নতুন দলে যোগ দেবেন। কিন্তু তারই পাশাপাশি জোরাল জল্পনা তৈরি হয়েছে ব্যারাকপুরের বিধায়ক শীলভদ্র দত্ত এবং পূর্ব বর্ধমানের সাংসদ সুনীল মন্ডলকে নিয়ে। দু’জনেই এখনও দলের বিরুদ্ধে জোরাল ভাবে কিছু বলেননি। শীলভদ্র জানিয়েছেন, তিনি আর ভোটে দাঁড়াতে চান না। দলকেও তা জানিয়ে দিয়েছেন। তবে বিজেপি সূত্রের খবর, শীলভদ্র শুভেন্দুর সঙ্গে ‘যোগাযোগ’ রেখে চলছেন। ঘটনাচক্রে, শুভেন্দু মন্ত্রিত্ব ছাড়ার পর শীলভদ্র তাঁর ফেসবুক ওয়ালে গেরুয়া রংয়ের উপর লিখেছিলেন, ‘বন্ধু দেখা হবে’। তাঁকে ঘিরে জল্পনা চলতে চলতেই শুভেন্দুর সঙ্গে সুনীলের পোস্টার পড়ল বর্ধমানে। যাকে সুনীল ‘মানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ’ বলে ব্যাখ্যা করেছেন।
সুনীল বলেছেন, শুভেন্দুর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ভাল। তাঁর মাতৃবিয়োগের পর শুভেন্দু ফল-মিষ্টি পাঠিয়েছিলেন। তাঁর কথায়, ‘‘বিরোধী বলেই প্রতিহিংসার রাজনীতি করতে হবে, এটায় আমি বিশ্বাস করি না। রাজনীতিতেও স্নেহ-ভালবাসা থাকবে। একজন বিজেপি-র লোক যদি কাজ নিয়ে আসে, তা হলে কি আমি সাংসদ হিসেবে তাঁকে সাহায্য করব না? তা হলে সে যাবে কোথায়?’’ পাশাপাশিই তাঁ ক্ষোভ, ‘‘এমন হলে রাজনীতি করব না। বাড়িতে বসে যাব। আমার জেলা সভাপতি আমি সাংসদ হওয়ার পর আমায় একটা মিটিংয়েও ডাকেনি। বিডিও-রে বলে দেওয়া হচ্ছে, যাতে আমায় না ডাকে। তাতে যদি আমার জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়! আমায় দল সম্মান দিয়েছে ঠিকই। কিন্তু ঠিকমতো কাজ করতে দেয়নি। আমি তো ভাবছি, রাজনীতিটাই ছেড়ে দেব! এই ঘোলা জলে থাকা আমার দ্বারা হবে না।’’ অন্য কোনও দল তাঁকে ভাল প্রস্তাব দিলে কী করবেন? সুনীলের জবাব, ‘‘সে সব কেউ এখনও বলেনি। আমিও কিছু ভাবিনি। অনেক বুকের জ্বালা থেকে এই কথাগুলো বলছি।’’
প্রসঙ্গত, আসানসোল পুরসভার প্রধান প্রশাসক জিতেন্দ্র তিওয়ারি সরাসরি পুরমন্ত্রী ফিরহাদ (ববি) হাকিমকে চিঠি লিখে দলের নীতি নিয়ে আপত্তি জানিয়েছিলেন। তাঁকে কলকাতায় বৈঠকে ডেকেছিল তৃণমূল। সেখানে ববিরও থাকার কথা ছিল। কিন্তু জিতেন্দ্র জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়া কারও সঙ্গে কথা বলবেন না। তাঁর দাবিমতোই আগামী শুক্রবার জিতেন্দ্র সঙ্গে মমতার বৈঠক হতে পারে বলে তৃণমূল সূত্রের খবর। কিন্তু এখনও জিতেন্দ্র ক্ষোভ প্রশমিত হয়েছে বলে খবর নেই। তার মধ্যেই প্রকাশ্যে এল সুনীল-শুভেন্দুর পোস্টার।
শুভেন্দুর সঙ্গে সুনীলের ওই পোস্টার মিলেছে দুর্গাপুরে এবং সুনীলের বাড়ির কাছে। সুনীল অবশ্য বলছেন, ‘‘পোস্টার যে কেউ মারতে পারে। কে মারছে, তা তো আমি বলতে পারব না। আমার মাতৃবিয়োগ হয়েছিল। তাই রাজনীতির সঙ্গে যোগ ছিল না। তবে এটা বলতে পারি যে, মানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটছে। জিতেন্দ্র তিওয়ারিও দলের বিরুদ্ধে ক্ষোভ জানিয়েছেন। আমি তো তা করিনি!’’ পাশাপাশিই তৃণমূলের এই সাংসদ বলেছেন, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, নতুন-পুরনো মিলেমিশে কাজ করতে হবে। সেটা অতি উত্তম প্রস্তাব। কিন্তু সেটা কি হচ্ছে? সেটা মানা হচ্ছএ না। এখনও সচেতন হচ্ছে না দল। এখনও দলের এক শ্রেণির যাঁদের হাতে ক্ষমতা আছে, তাঁরাই চাইছেন না দলটা থাকুক। দুর্দিনে এখনও সচেতন হচ্ছে না দল! আমি অরূপ বিশ্বাস, স্বপন দেবনাথের সামনে একজন বিধায়কের বিরুদ্ধে বলেছিলাম, সে অমুক অমুক ক্লাব থেকে টাকা তুলেছে। তার পরে দেখলাম, তাঁকেই দলের বড় দায়িত্বে দেওয়া হল!’’
পোস্টার প্রসঙ্গে সুনীলের আরও বক্তব্য, ‘‘আমার পক্ষে এই রাজনীতিতে থাকা মুশকিল।’’ তৃণমূল নিযুক্ত ভোট-কৌশলী প্রশান্ত কিশোর সম্পর্কে এই সাংসদের মূল্যায়ন, ‘‘ওঁর সম্পর্কে বলতে গেলে এটুকুই বলতে পারি, তা হলে বিজ্ঞানে প্র্যাকটিক্যাল ব্যাপারটা থাকত না। যারা সায়েন্স পড়ে, তাদের জন্য প্র্যাক্টিক্যালে ৪০ নম্বর থাকে। হাতের কাজের জন্য। আমরা যাঁরা রাজনীতি থেকে উঠে এসেছি, যেমন সুব্রত মুখোপাধ্যায়, পার্থ চট্টোপাধ্যায়, সুব্রত বক্সি, শুভেন্দু অধিকারী, রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়রা তো নিজে রাজনীতিটা করেছে। তাদেরও এখন পিকে-র বেতনভুক কর্মচারীর কথা শুনে মিটিং করতে হচ্ছে। মিছিল করতে হচ্ছে। এটা একটচা দলের পক্ষে শোভা পায় না। পিকে-কে ভিতরে ভিতরে কেউই মানছে না। দলের নির্দেশ বলে মেনে নিচ্ছে। আমি ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি, দলে এই বিষয়ে সংশোধনের প্রয়োজন আছে।’’ তাঁর আরও অভিযোগ, ‘‘পয়সার বিনিময়ে নেতৃত্ব দিয়ে দেওয়া হচ্ছে! নেত্রী যদি একা দায়িত্ব নিয়ে সাংগঠনিক দায়িত্ব নিলে বা সুব্রত, বক্সি, পার্থরা দলের দায়িত্ব নিলে এই দুরবস্থা হত না। ভাড়াটে সৈন্য দিয়ে কোনওদিন যুদ্ধ জেতা যায় না।’’
পিকে-কে নিয়ে তৃণমূলের মধ্যে ইতিউতি ক্ষোভ-অনুযোগের সুর বেশ কিছুদিন ধরেই শোনা যেতে শুরু করেছে। কিন্তু ওই বিষয়ে এত সরাসরি এবং প্রকাশ্যে সুনীলই প্রথম বললেন। তাঁর কথায়, ‘‘এটা কতদিন চলবে, সেটা আমি বলতে পারব না। মানুষ এখন অনেক সচেতন। মানুষ তোমার মিটিং-মিছিলে এলেই তোমায় ভোট দেবে না। মানুষের ভিতর এবং বাইরেটা আলাদা হয়ে গিয়েছে।’’ সুনীলের প্রাথমিক বক্তব্যের পর তৃণমূলের মুখপাত্র তথা রাজ্যসভার প্রাক্তন সাংসদ কুণাল ঘোষ বলেছেন, ‘‘ওঁর আবার বিবেক জাগ্রত হয়েছে। যখন গলসির ফরওয়ার্ড ব্লকের বিধায়ক ছিলেন, তখন একবার বিবেক জাগ্রত হয়েছিল। এখন আবার বিবেক জেগে উঠেছে।’’