জয়নগরের মোয়া
উত্তুরে হাওয়ায় মাঠে দোল খাচ্ছে পাকা কনকচূড়। মাথা ঝাঁকাচ্ছে খেজুর গাছ। আর বাড়ির দাওয়ায় বসে দিন গুনছেন বাবলু ঘোষ। জয়নগরের এই মোয়া কারবারির চিন্তা, কবে মিটবে নগদের আকাল!
নোটের চোটে এই শীতে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে জয়নগরের মোয়া ব্যবসাও। শুধু বাবলুবাবুই নন, তাঁর মতো বিপাকে পড়েছেন অনেক মোয়া কারবারিই। কারণ, নগদে টান। কারবার শুরু করার পুঁজিটুকুও মিলছে না যে!
অন্যান্য বার এই সময়ে দক্ষিণ ২৪ পরগনার এ তল্লাটে মোয়া কারবারিদের খাওয়ার সময় থাকে না। তাঁরা জানিয়েছেন, শীতের দু’তিন মাসে অন্তত ১০ কোটি টাকার ব্যবসা হয়। কিন্তু এ বার তাঁরা অথৈ জলে। হাতে নগদ টাকা না-থাকায় ধান কাটার লোক লোক মিলছে না। খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহের ‘শিউলি’ও অমিল। অথচ, এ বার শুধু বিদেশ থেকেই মোয়ার যা বরাত এসেছে, তাতে লাভের পরিমাণ গত বারের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ হওয়ার আশায় ছিলেন ব্যবসায়ীরা। অথচ, এখন তাঁরা হতাশায় ভুগছেন।
শীতে জয়নগরের মোয়ায় কামড় বসাননি এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া ভার। দেশে-বিদেশে এই মোয়ার কদর রয়েছে। দক্ষিণ ২৪ পরগনার জয়নগর এবং বহড়ু এলাকায় ঘরে ঘরে এই মোয়া তৈরি হয়। উপাদান কনকচূড় ধান, নলেন গুড়, কাজু, পেস্তা, কিসমিস, গাওয়া ঘি, মধু এবং খোয়া ক্ষীর। মোয়া কারবারিরা জানান, অঘ্রাণের শুরুতেই মোয়ার ‘ভিত’ তৈরি হয়। মাঠ থেকে ধান কেটে ঝাড়ার
পর খই ভাজা হয়। ডালপালা ছেঁটে
রস সংগ্রহের জন্য খেজুর গাছকে ‘তৈরি’ করা হয়। কিন্তু এ বার শুরুতেই ধাক্কা। তাঁদের হাতে টাকা নেই। যা আছে, তা মূলত অচল ৫০০ বা এক হাজার টাকার নোট।
বস্তুত, এখানে গোটা ব্যবসাটাই হয় নগদে। ব্যবসার সঙ্গে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভাবে অন্তত দু’লক্ষ মানুষ জড়িত। ব্যবসায়ীরা জানান, মোয়ার জন্য প্রায় পাঁচ হাজার কুইন্টাল কনকচূড় ধান এবং চার হাজার লিটার নলেন গুড় দরকার হয়। কাজু, কিসমিস তো আছেই। ধান কাটা থেকে শুরু করে মোয়া বানিয়ে প্যাকেটবন্দি করতে অন্তত ১৫ দিন সময় লাগে। দিনপ্রতি ‘শিউলি’দের দিতে হয় প্রায় ২০০ টাকা। ধান কাটার শ্রমিক, গুড়-মোয়ার কারিগরদের দিতে হয় ৫০০-৬০০ টাকা করে। সব মিলিয়ে ব্যবসায়ীদের দিনপ্রতি খরচ হয় কয়েক লক্ষ টাকা। অন্যান্য বার ব্যাঙ্ক থেকে মরসুমের শুরুতে এই টাকা পেতে সমস্যা হতো না। কিন্তু এ বার বিধি বাম! ৫০০ এবং এক হাজার টাকার নোট বাতিল হয়ে যাওয়া এবং তার পরে ব্যাঙ্ক থেকে সামান্য টাকা পেতেও যে ঝক্কি পোয়াতে হচ্ছে, তাতে এ বার ব্যবসায় অশনিসঙ্কেত দেখছে জয়নগর।
এখানকার ব্যবসায়ী এবং শ্রমিকেরা এই তিন মাসেই সারা বছরের উপার্জন করেন। শীতের মরসমে জয়নগরের অনেক মোয়া কারিগর রাজ্যের নানা প্রান্তেও ছড়িয়ে পড়েন। সেই সব জায়গায় অস্থায়ী ভাবে থেকে তাঁরা ‘জয়নগরের মোয়া’ বানান। কিন্তু এ বার তাঁরাও সে
ভাবে ডাক পাননি। মোয়া কারবারিদের আক্ষেপ, ব্যাঙ্কে টাকা রয়েছে। কিন্তু ব্যবসায়িক চাহিদা মেটানোর মতো মোটা টাকা একসঙ্গে তোলা যাচ্ছে না। তাঁদের প্রশ্ন, ‘‘চার-পাঁচ হাজার টাকায় কী হবে?’’
জয়নগরে যে সব শ্রমিক খই-মোয়া তৈরি করেন, তাঁদের সংগঠনের উপদেষ্টা তথা প্রাক্তন বিধায়ক তরুণ নস্কর বলেন, ‘‘হয়তো বড় ব্যবসায়ীরা ধারদেনা করেও মোয়া বানাতে পারবেন। কিন্তু তেমন পুঁজি হাতে না-থাকায় ব্যবসায়ীদের একটি বড় অংশ পথে বসবেন।’’ বহড়ুর মোয়া ব্যবসায়ী রঞ্জিত ঘোষ বলেন, ‘‘এ বছর অগস্ট মাস থেকে বিদেশের প্রচুর বরাত পেয়েছি। লাভের পরিমাণও প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যেত। কিন্তু এখন সে আশা ছেড়েছি। ব্যবসা কী ভাবে শুরু করব, তা ভেবেই ঘুম চলে গিয়েছে।’’
আপাতত ৫০০ টাকার নতুন নোটের দিকে চেয়ে আছেন কারবারিরা। তাঁরা মনে করছেন, সপ্তাহখানেকের মধ্যে ৫০০ টাকার নতুন নোট এলাকার ব্যাঙ্ক থেকে মিললে বা পর্যাপ্ত পরিমাণে একশোর নোট পাওয়া গেলে লোকসান অন্তত কিছুটা সামাল দেওয়া যাবে। কেউ কেউ ঠিক করছেন, শ্রমিকদের কিছু টাকা অগ্রিম দিয়ে ধান ও খেজুর গাছ কাটার ব্যবস্থা করার। তবু সংশয় যাচ্ছে না।
কারবারিরা মানছেন, এমন পরিস্থিতি কোনও দিন হয়নি। কী করবেন, তাঁরা বুঝে উঠতে পারছেন না।