মৃত ছাত্রের দিদি। নিজস্ব চিত্র
স্কুল থেকে বেরিয়ে পারমিতা দেখেছিল, ভাইয়ের ছুটির জন্য অপেক্ষা করছে মা। তাকে বলেছিল, ‘‘বাড়ি গিয়ে খেয়ে নে।’’ বাড়ি ফিরে ভাত গলা দিয়ে নামতে না-নামতেই এসেছিল খবরটা। স্কুল থেকে ফেরার পথে মা আর ভাইকে পিষে দিয়েছে বেপরোয়া গাড়ির চাকা।
খাবার ফেলেই ছুটে গিয়েছিল পারমিতা। রসকুঞ্জের বাঁকরাহাট রোডে পড়েছিল মা সুলেখা সর্দারের (৪০) নিথর দেহ। সাত বছরের একরত্তি ভাইকে তখন হাসপাতালে নিয়ে ছুটছে লোকজন। মায়ের জন্য কত ক্ষণ কেঁদেছিল মনে নেই তার। তারই মাঝে খবর এসেছিল, মারা গিয়েছে ভাই অভিজিৎ সর্দারও।
রসকুঞ্জের চড়কতলায় সতেরো বছরের মেয়ে পারমিতা এবং সাত বছরের ছেলে অভিজিৎকে নিয়ে সংসার দিলীপ সর্দার ও সুলেখা সর্দারের। দিলীপ স্থানীয় একটি প্লাইউড কারখানায় কাজ করেন। সুলেখাদের আত্মীয়-পড়শিরা জানান, পারমিতার জন্মের ১১ বছর পরে অভিজিতের জন্ম। সর্দার দম্পতি বলতেন, ঈশ্বরের দয়াতেই নাকি ছেলে পেয়েছেন তাঁরা। অভিজিৎকে তাই একটু বেশিই আগলে রাখতেন সুলেখা ও দিলীপ। পারমিতা রসকুঞ্জ গার্লস স্কুলে একাদশ শ্রেণিতে পড়ে। পাশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করেছিলেন ছেলেকে। অভিজিৎ পড়ত প্রথম শ্রেণিতে।
পড়শিরা জানালেন, রোজ দুপুরে টিফিন টাইমে ছেলেমেয়ের জন্য খাবার নিয়ে যেতেন সুলেখা। সোমবার বেলা দেড়টা নাগাদও গিয়েছিলেন। মেয়েকে খাবার পৌঁছে দিয়ে গিয়েছিলেন ছেলের স্কুলে। ছেলেকে খাবার খাইয়ে স্কুলের বাইরেই অপেক্ষা করছিলেন তিনি। এটাই ছিল তাঁর রোজের রুটিন। স্কুল ছুটির পরে রসকুঞ্জের রাস্তা ধরে সামান্য পথটুকু হেঁটেই ছেলেকে নিয়ে বাড়ি ফিরতেন সুলেখা। এ দিন সেই রাস্তাটা আর ফুরলো না!
সন্ধেয় রসপুঞ্জের চড়কতলায় সুলেখাদের বাড়ি পৌঁছে দেখা গেল, ইটের গাঁথনি, টিনের চাল দেওয়া একতলা বাড়িতে আত্মীয়-পরিজন-পড়শিদের ভি়ড়। বাড়ির বারান্দায় আছাড়িপিছাড়ি খেয়ে কেঁদে চলেছে পারমিতা। বলছে, ‘‘মা তুমিও চলে গেলে, ভাইও চলে গেল! আমি কী ভাবে বাবাকে নিয়ে থাকব?’’
স্ত্রী-পুত্রের দুর্ঘটনার খবর শুনেই কারখানা থেকে চলে এসেছিলেন দিলীপ। মৃত্যুসংবাদ শোনার পর থেকে নিজেকে ঘরবন্দি করে নিয়েছেন। মাঝেমাঝেই জ্ঞান হারাচ্ছেন তিনি। কাঁদতে কাঁদতে মাঝেমধ্যে প্রলাপ বকছে পারমিতাও।
অভিজিতের সঙ্গে একই ক্লাসে পড়ত চড়কতলার বাসিন্দা মৃত্তিকা দাস। তার মা কাজলও এ দিন ছুটির পরে মেয়েকে আনতে গিয়েছিলেন। ফিরছিলেন সুলেখাদের সঙ্গেই। বেপরোয়া গাড়ির ধাক্কায় রাস্তার পাশে ছিটকে পড়েন মা ও মেয়ে। তবে সুলেখা-অভিজিতের মতো পরিণতি হয়নি তাঁদের। বরাতজোরে দু’জনে বেঁচে গিয়েছেন। স্থানীয় একটি হাসপাতালে চিকিৎসার পর দু’জনকে ছেড়ে দিয়েছেন চিকিৎসকেরা।