মাওবাদীরা যে কায়দায় জঙ্গলমহলকে নিজেদের মুক্তাঞ্চল বানাতে চেয়েছিল, পাহাড়েও সেই কায়দাতেই পুলিশ-প্রশাসনকে অকেজো করে দিতে চাইছে মোর্চা। মনে করছেন গোয়েন্দারা। ছবি: পিটিআই।
পাহাড়ের আন্দোলন আর গণতান্ত্রিক নেই, পুলিশ-প্রশাসনের উপর সশস্ত্র হামলার ছক কষা হয়েছে এবং তার জন্য বিদেশ থেকেও মাওবাদীদের আনা হয়েছে। এমনটাই দাবি করছে রাজ্য পুলিশ, প্রশাসন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আগেই পাহাড়ের অশান্তিতে ভিনদেশি জঙ্গিদের হাত আছে বলে অভিযোগ তুলেছিলেন। এডিজি আইন-শৃঙ্খলা অনুজ শর্মাও সম্প্রতি সংবাদ সংস্থা পিটিআই-কে দেওয়া সাক্ষাত্কারে এমন কথা বলেছেন। শুধু পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ নয়, একাধিক কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এবং ঝাড়খণ্ড পুলিশও গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার সঙ্গে মাওবাদীদের যোগাযোগের তথ্য হাতে পেয়েছে বলে খবর। মোর্চার তরফে এই অভিযোগ অবশ্য পুরোপুরি নস্যাৎ করে দেওয়া হয়েছে।
নেপাল থেকে মাওবাদীদের দার্জিলিঙে এনেছে মোর্চা, এমনটাই খবর পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের কাছে। ‘‘বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে আমরা খবর পেয়েছি, গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা প্রতিবেশী দেশগুলি থেকে মাওবাদীদের ভাড়া করে এনেছে। তারা সরকারি সম্পত্তি এবং পুলিশ-প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্তাদের নিশানা বানাতে পারে, যাতে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত করে তোলা যায়।’’ সংবাদ সংস্থা পিটিআই-কে এ কথা বলেছেন রাজ্য পুলিশের এডিজি (আইন-শৃঙ্খলা) অনুজ শর্মা।
কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এসআইবি এবং সিআরপিএফ-এর গোয়েন্দা শাখাও দার্জিলিঙের পরিস্থিতির উপর গোড়া থেকেই নজর রাখছে। তারাও গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার সঙ্গে মাওবাদীদের যোগাযোগের সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছে না। ২৫ থেকে ৩০ জন মাওবাদী এই মুহূর্তে পাহাড়ে রয়েছেন বলে গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রের খবর। তারা মোর্চার কর্মীদের আগ্নেয়াস্ত্র চালনা এবং গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। শান্তিরক্ষার নামে ‘গোর্খাল্যান্ড পার্সোনেল’ (জিএলপি) নামে যে সংগঠন মোর্চা তৈরি করেছে, সেই জিএলপি ক্যাডারদেরই অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে বলে খবর।
শুধু নেপাল থেকে অবশ্য নয়, ঝাড়খণ্ড থেকেও বেশ কিছু মাওবাদী দার্জিলিঙে পৌঁছেছেন বলে মনে করা হচ্ছে। ঝাড়খণ্ড পুলিশের কাছ থেকে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ এই সংক্রান্ত কিছু তথ্য পেয়েছে। ঝাড়খণ্ডের পূর্ব সিংভূম জেলা এখনও মাওবাদীদের শক্ত ঘাঁটি। সেখানে মাওবাদী কার্যকলাপ এখনও উল্লেখযোগ্য। দার্জিলিঙে যে সময়ে গোলমাল শুরু হল, সে সময়ে পূর্ব সিংভূমের বেশ কিছু মাওবাদীর মোবাইলের টাওয়ারের লোকশন খুঁজে দেখা গিয়েছে, ওই সেলফোনগুলি তখন দার্জিলিং এবং আশপাশের এলাকায় ঘোরাফেরা করছিল।
মোর্চা বলছে আন্দোলন গণতান্ত্রিক। কিন্তু নিরাপত্তা সংস্থাগুলি বলছে, সশস্ত্র আন্দোলনের ভয়ঙ্কর ছক কষেছেন বিমল গুরুঙ্গরা। ছবি: এএফপি।
রাজ্য পুলিশের মতে, মাওবাদীদের সঙ্গে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার যোগসূত্র নতুন নয়। লালগড়ে যে সময় জনসাধারণের কমিটির আন্দোলন তুঙ্গে, সে সময়ও বিমল গুরুঙ্গরা জঙ্গলমহলে গিয়েছিলেন। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে বড়পেলিয়া চকে গুরুঙ্গদের বৈঠকও হয়েছিল। এই বড়পেলিয়া সে সময় মাওবাদীদের বড় ঘাঁটি ছিল। সেই পুরনো যোগসূত্র ধরেই এখন পাহাড়ে মাওবাদীদের ডেকে নিয়েছে মোর্চা। মনে করছেন গোয়েন্দারা।
যে ভাবে এক মাসেরও বেশি সময় ধরে পাহাড় অচল করে রাখা হয়েছে, তাতে পাহাড়ে খাবার এবং অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহে তীব্র সঙ্কট তৈরি হওয়ার কথা। কিন্তু তেমন কোনও সঙ্কট পাহাড়ে এখনও নেই। রাতের অন্ধকারে নেপাল থেকে এবং সিকিম থেকে দার্জিলিঙে অনেক জিনিসপত্র ঢুকছে বলে জানা গিয়েছে।
আরও পড়ুন: নতুন নেতা চায় পাহাড়, মত হরকার
মোর্চা নেতৃত্ব মাওবাদী যোগের অভিযোগ সম্পূর্ণ অস্বীকার করছে। দলের সাধারণ সম্পাদক রোশন গিরি বলেছেন, ‘‘এ সব সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন অভিযোগ। আমাদের কালিমালিপ্ত করতে এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলনটাকে ভাঙতে এই সব কথা বলা হচ্ছে।’’
পাহাড়ে গোলমাল শুরু হওয়ার পরই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মোর্চার বিরুদ্ধে জঙ্গি যোগের অভিযোগ তুলেছিলেন। ভিনরাজ্য থেকে এবং বিদেশ থেকে অস্ত্রশস্ত্র ও লোকজন পাহাড়ে ঢোকানো হয়েছে বলে তিনি অভিযোগ করেছিলেন। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলির হাতেও এ বার তেমন তথ্যই পৌঁছেছে বলে খবর। রাজ্য প্রশাসন পাহাড়ে নজরদারি কড়া করেছে। জঙ্গলমহলে মাওবাদী দমন অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছেন, এমন একাধিক পুলিশ অফিসারকে ইতিমধ্যেই পাহাড়ে পাঠিয়েছে নবান্ন। পরিস্থিতির দিকে সতর্ক নজর রাখা হচ্ছে।