উন্নয়নের স্বার্থে মুখোমুখি দুই ‘ম’, মুখ ফিরিয়েই আর এক

জন্মলগ্ন থেকে টানা ছ’বছর এক সঙ্গে (মাঝে কয়েক মাসের জন্য অবশ্য বিচ্ছেদ হয়েছিল) ঘর করেছিলেন। তবু বঞ্চনার রাজনীতি আর ধর্মনিরপেক্ষতা নামের দু’টো শব্দকে বাঁচিয়ে রাখতে এক মুখ্যমন্ত্রী এতটাই মরিয়া যে, একদা বন্ধু দলের নেতা তথা দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর মুখোমুখিই হতে চান না! প্রশ্নটা রাজ্যের উন্নয়নের হলেও না।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ০২ ডিসেম্বর ২০১৪ ০৩:০৯
Share:

বাম দুর্গে নরেন্দ্র মোদীকে স্বাগত জানাচ্ছেন ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার। সোমবার আগরতলায়। ছবি: বাপি রায়চৌধুরী

জন্মলগ্ন থেকে টানা ছ’বছর এক সঙ্গে (মাঝে কয়েক মাসের জন্য অবশ্য বিচ্ছেদ হয়েছিল) ঘর করেছিলেন। তবু বঞ্চনার রাজনীতি আর ধর্মনিরপেক্ষতা নামের দু’টো শব্দকে বাঁচিয়ে রাখতে এক মুখ্যমন্ত্রী এতটাই মরিয়া যে, একদা বন্ধু দলের নেতা তথা দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর মুখোমুখিই হতে চান না! প্রশ্নটা রাজ্যের উন্নয়নের হলেও না।

Advertisement

প্রতিবেশী রাজ্যের এক মুখ্যমন্ত্রীর অবস্থান অবশ্য পুরোপুরি আলাদা। রাজনৈতিক আদর্শের দিক থেকে তো বটেই, অন্য বহু ব্যাপারেও তিনি বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর বিপরীত মেরুতে। সেই তিনিই কিন্তু রাজ্যের উন্নয়নের স্বার্থে সংকীর্ণ দলাদলির রাজনীতি এড়িয়ে গেলেন সযত্নে।

একটা রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ, অন্যটা ত্রিপুরা। দু’রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীই বাঙালি।

Advertisement

ছ’মাস হয়েছে কেন্দ্রে সরকার গড়েছেন নরেন্দ্র মোদী। এখনও পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎটুকুও হয়নি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়ন সংক্রান্ত সহস্র সমস্যা আছে। সে সব নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা না বলে ‘বঞ্চনার রাজনীতি’ স্লোগানকেই আঁকড়ে ধরে রয়েছেন মমতা। প্রতিবেশী ত্রিপুরার পোড় খাওয়া বাম নেতা মানিক সরকার কিন্তু সে পথে হাঁটলেন না। প্রধানমন্ত্রীকে আগরতলায় নিমন্ত্রণ করে এনে মন্ত্রিসভার সব সদস্যকে সঙ্গে নিয়ে তাঁর সঙ্গে বৈঠক করলেন তিনি। বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিকাঠামো উন্নয়ন ও আর্থ-সামাজিক একাধিক বিষয়ে সাহায্যের জন্য মোদীর প্রাথমিক আশ্বাস আদায়ও করে নিলেন তিনি।

ত্রিপুরার পালাটানায় একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নতুন ইউনিটের উদ্বোধনে এ দিন দুপুর ২টো নাগাদ বিশেষ বিমানে আগরতলায় পৌঁছন মোদী। বিমানবন্দরে তাঁকে স্বাগত জানাতে হাজির ছিলেন মানিক সরকার-সহ রাজ্য মন্ত্রিসভার ১০ সদস্য। রাজ্যপাল পি বি আচার্য ও মুখ্যমন্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে বায়ুসেনার হেলিকপ্টারে পালাটানা রওনা দেন মোদী। সেখান থেকে আগরতলায় ফেরেন বিকেল সওয়া ৪টেয়।

প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ত্রিপুরা মন্ত্রিসভার এই বৈঠকটি রাজ্য সচিবালয়ে হওয়ার কথা থাকলেও গত শনিবার প্রধানমন্ত্রীর দফতর (পিএমও) থেকে ত্রিপুরা প্রশাসনকে জানানো হয়, পালাটানায় বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নতুন ইউনিটের উদ্বোধনের পর সেখানে হাজির জমায়েতে বক্তৃতা দিয়েই দিল্লি ফিরে যাবেন মোদী। তার পরে এ দিন সকালে ফের পিএমও-র তরফে খবর আসে, পালাটানা থেকে আগরতলায় ফিরে রাজ্য অতিথিশালায় মন্ত্রিসভার বৈঠকে সামিল হবেন প্রধানমন্ত্রী। প্রশাসনিক সূত্রের খবর, মানিকবাবুর অনুরোধেই শেষ মুহূর্তে সফরসূচি বদলে দেন মোদী। ত্রিপুরার মন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠকে রাজি হন। রাজ্যের বামনেতাদের একাংশের দাবি, দেশে এর আগে কখনও এমন বৈঠক হয়নি।

সূত্রের খবর, রাজ্য অতিথিশালায় ৪০ মিনিটের ওই বৈঠকে রাজ্যের মন্ত্রীদের সঙ্গে উন্নয়ন প্রকল্পের খুঁটিনাটি নিয়ে সবিস্তার কথা বলেন মোদী। রাজ্য সরকারের তরফে প্রধানমন্ত্রীর হাতে একটি দাবিসনদ তুলে দেন মুখ্যমন্ত্রী। তাতে ৯ দফা দাবি জানানো হয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে ত্রিপুরায় গ্যাস-ভিত্তিক ইউরিয়া কারখানা দ্রুত চালু করা, আইআইএম, আইআইটি, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় তৈরির অনুরোধ। ত্রিপুরার সঙ্গে দেশের অন্য প্রান্তের রেল, সড়ক, বিমান যোগাযোগ ব্যবস্থা আরও উন্নত করার দাবিও জানানো হয়। উত্তর-পূর্ব ভারতের স্বার্থে পড়শি বাংলাদেশের দু’টি বন্দর সারা বছর যাতে ব্যবহার করা যায়, সে বিষয়ে দিল্লিকে পদক্ষেপ করার অনুরোধও করেন রাজ্যের মন্ত্রীরা। একই সঙ্গে দেশের অন্য প্রান্তের সঙ্গে ত্রিপুরার বিদ্যুৎ যোগাযোগের পরিকাঠামো মজবুত করার কথা বলেন মানিকবাবু। আগরতলায় ১১৫ একরের একটি জমি প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের কাছ থেকে নিয়ে রাজ্য প্রশাসনকে হস্তান্তর করার অনুরোধও প্রধানমন্ত্রীকে করা হয়। বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিকাঠামো উন্নয়নের কথা বলা হলেও মানিক সরকারের মন্ত্রিসভা কিন্তু রাজ্যের ঋণ মকুব বা কেন্দ্রের কাছে নতুন কোনও আর্থিক প্যাকেজের দাবি করেনি।

ত্রিপুরা মন্ত্রিসভার দাবিগুলি মন দিয়েই শুনেছেন প্রধানমন্ত্রী। মানিকবাবুর কাছে জানতে চেয়েছেন, রাজ্যের কিছু উল্লেখযোগ্য সাফল্যের কথা। ত্রিপুরায় জঙ্গি সমস্যা কী ভাবে মিটেছে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্যও চান মোদী। রাজনৈতিক ভাবে বিপরীত মেরুতে থেকেও দলের সবেধন নীলমণি মুখ্যমন্ত্রীর এই পদক্ষেপকে কিন্তু স্বাগত জানিয়েছে সিপিএম পলিটব্যুরো। দলের পলিটব্যুরো সদস্য সীতারাম ইয়েচুরি বলেন, “প্রধানমন্ত্রী কোনও রাজ্য সফরে গেলে বাম মুখ্যমন্ত্রীরা বরাবর তাঁদের স্বাগত জানান। সুশাসন কী ভাবে কায়েম করতে হয়, সেই জ্ঞান অবশ্যই প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে নেননি মানিকবাবু। সেটা প্রধানমন্ত্রীকে উনিই শেখাতে পারেন। রাজ্যের উন্নয়ন নিয়ে দাবিদাওয়াগুলি মোদীর সামনে তুলে ধরা হয়েছে।”

দিল্লি-আগরতলা এই সমন্বয় দেখে বাংলার শাসক দল কী বলছে?

মনমোহন জমানায় শেষ লগ্নে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রায় প্রতিদিনই যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো নিয়ে বিস্তর কথা বলতেন। বলতেন কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের উন্নতির কথাও। কিন্তু এখন সেটা বলা কঠিন। তা হলে মোদীর সঙ্গে মুখোমুখি বসতে হয় যে! এই পরিস্থিতিতে আজ ত্রিপুরা-বৈঠক নিয়ে তাঁর দলের তরফে যা বলা হয়েছে, তা অনেকের কাছেই প্রত্যাশিত ছিল। তৃণমূল সাংসদ ডেরেক ও’ব্রায়েন বলেছেন, “সিপিএম-বিজেপি ভাই ভাই। আগে তলে তলে আঁতাত করত। এখন খোলাখুলি করছে।”

রাজনীতির সঙ্গে যুক্তরা তো বটেই অরাজনৈতিক অনেকেও বলছেন, মমতা বা তাঁর দলের কাছে এমন আচরণ নতুন নয়। এটা ভাবলে ভুল হবে যে মমতা ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির অঙ্ক মেনে মোদীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতটুকুও করতে চান না। অতীতে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ কলকাতা সফরে গেলেও মমতা তাঁর সঙ্গে দেখা করেননি। অসৌজন্যের এই রাজনীতি তাই নতুন নয়।

মানিকবাবু অবশ্য আজকের বৈঠক নিয়ে অকপট। রাজ্যের উন্নয়নই পাখির চোখ তাঁর। তাই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক সেরে তিনি বলে দেন, “আমি দেশের প্রধানমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানিয়েছি, কোনও বিজেপি নেতাকে নয়।” একশো দিনের কাজ প্রকল্পে ত্রিপুরার বরাদ্দ কমানো নিয়ে গত মাসের শুরুতেই প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি পাঠিয়েছিলেন মানিকবাবু। তারও আগে, গত অগস্টে দিল্লিতে সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে যোগ দিতে গিয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখাও করেন।

আগামী ৭ ডিসেম্বর নয়াদিল্লিতে মুখ্যমন্ত্রীদের সম্মেলন ডেকেছেন প্রধানমন্ত্রী। সেখানে উপস্থিত থাকবেন মানিকবাবু। মমতা সেই বৈঠকে যাবেন কি না, তা এখনও স্পষ্ট নয়। এর আগে প্রধানমন্ত্রীর ডাকা এক সম্মেলনে অমিত মিত্রকে পাঠিয়েছিলেন মমতা। নবান্ন সূত্রের খবর, শেষ মুহূর্তে বড় কোন পরিবর্তন না হলে এ বারও প্রধানমন্ত্রীর ডাকা ওই বৈঠকে না-ও যেতে পারেন মুখ্যমন্ত্রী।

তফাৎ রয়েছে দু’রাজ্যের সাংসদদের আচরণেও। ত্রিপুরার সাংসদরা যখন রাজ্যের উন্নয়নের জন্য কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের কাছে দরবার করছেন তখন পশ্চিমবঙ্গের সাংসদরা কালো ছাতা, কালো চাদর, হাঁড়ি নিয়ে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন। ক্যামেরার সামনে পোজও দিচ্ছেন!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement