একান্ত বৈঠকে, সংসদে প্রধানমন্ত্রীর ঘরে। ছবি: পিটিআই।
প্রথমে একান্তে আধ ঘণ্টার বৈঠক। দু’জনের রাজনৈতিক আলাপচারিতা। সূত্রের মতে, যার মধ্যে রয়েছে সিবিআই তদন্ত থেকে তিস্তা চুক্তির মতো নানা সাম্প্রতিক ঘটনা। তার পর সংসদের গ্রন্থাগারে তৃণমূলের ৪০ জন সাংসদকে নিয়ে আরও প্রায় পঁচিশ মিনিট। সেখানে পশ্চিমবঙ্গের বেহাল আর্থিক পরিস্থিতি ও রাজ্যের সামগ্রিক উন্নয়ন নিয়ে আলোচনা।
কেন্দ্রে বিজেপি ক্ষমতায় আসার ন’মাস পরে অবশেষে একই টেবিলে মুখোমুখি নরেন্দ্রভাই মোদী এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেখানে কেন্দ্রীয় ঋণ মকুব করার আশ্বাস না দিলেও উন্নয়নে সহযোগিতার হাত বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে রাখলেন মোদী। আর বৈঠকের পর মমতা জানালেন, ঋণভারে ন্যুব্জ অবস্থাতেও পশ্চিমবঙ্গ সরকার যে আর্থিক শৃঙ্খলা দেখিয়েছে, তার প্রশংসা করেছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি মোদীকে কলকাতায় যাওয়ার জন্যও আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। এপ্রিল মাসের তৃতীয় সপ্তাহে রামনবমীর সময় মোদী কলকাতায় যেতে পারেন বলে ঠিকও হয়েছে। সে সময় মোদী বেলুড় মঠেও যাবেন।
অর্থাৎ প্রধান যে দাবি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আসা, তা পূরণ না হলেও মমতার দিক থেকে আজকের বৈঠক নিয়ে মোটের উপরে সদর্থক প্রতিক্রিয়াই মিলেছে। মোদীও টুইটারে মমতার সঙ্গে নিজের ছবি পোস্ট করে লিখেছেন, পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়নের জন্য সব রকম চেষ্টা করা হবে। মোদী এ কথাও মমতাকে জানিয়েছেন যে, রাজ্যের যে কোনও সমস্যা নিয়ে তাঁর সাংসদেরা যে কোনও সময়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে পারেন। মমতা নিজেও আসতে পারেন। মুখ্যমন্ত্রী যদি রাজ্য থেকে তাঁর কোনও দূত পাঠান, সে ক্ষেত্রেও প্রধানমন্ত্রীর দ্বার তাঁর জন্য অবারিত থাকবে।
অথচ প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর এই মোদীর সঙ্গেই সৌজন্য সাক্ষাৎ তো দূরস্থান, তাঁকে রীতিমাফিক শুভেচ্ছা পর্যন্ত জানাননি মমতা। সাংসদদের সঙ্গে বৈঠকের সময় প্রধানমন্ত্রী এ দিন মমতাকে সহাস্যে বলেও ফেলেছেন, বাংলার মিঠাই খাওয়ার জন্য তাঁকে দীর্ঘ ন’মাস অপেক্ষা করতে হল!
রাজনীতির আঙিনায় এখন তাই মূল প্রশ্ন হল, ন’মাস পর কী এমন ঘটল, যাতে যুযুধান দু’পক্ষই আলোচনার টেবিলে বসলেন?
রাজনৈতিক সূত্রের বক্তব্য, প্রয়োজনটা আসলে উভয় পক্ষেরই। জমি বিল-সহ বিভিন্ন বিল পাশ করানোর ক্ষেত্রে রাজ্যসভায় একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে তৃণমূল-সহ বিরোধী পক্ষ। প্রায় প্রতি ক্ষেত্রেই সরকার বিরোধিতার প্রশ্নে বিভিন্ন দলকে জোটবদ্ধ করায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদরাই। তাই এক দিকে যেমন পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে তৃণমূলের সঙ্গে লড়াই করে বিজেপি শক্তিবৃদ্ধি করতে চাইছে, অন্য দিকে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর ঐতিহ্যের কথা বলে রাজ্য সরকারের সঙ্গে সমান্তরাল ভাবে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চাইছেন মোদী। আবার সারদা তদন্ত থেকে শুরু করে মুকুল রায়ের বিদ্রোহ একের পর এক ধাক্কা সামলাতে মোদীর দ্বারস্থ হওয়াটা মমতার দিক থেকেও রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা বলেই মনে করা হচ্ছে।
সিপিএম সাংসদ মহম্মদ সেলিম যেমন মনে করাচ্ছেন, “একটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী দেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে যেতেই পারেন। কিন্তু রাজ্যের জন্য আর্থিক সাহায্য চাওয়ার যে সব মঞ্চ ছিল, সেখানে মুখ্যমন্ত্রী যাননি।” নীতি আয়োগের বৈঠক বা অর্থমন্ত্রীদের সম্মেলন সবই পেরিয়ে গিয়েছে। চতুদর্শ অর্থ কমিশনের বরাদ্দ ঘোষণা হয়ে গিয়েছে। এমনকী, কেন্দ্রীয় বাজেটও হয়ে গিয়েছে। সেলিমের প্রশ্ন, “এখন হঠাৎ আর্থিক সাহায্যের দাবি তোলার কথা মনে পড়ল কেন? সারদা-সহ নানা তদন্ত চলছে। দলের মধ্যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। এই পরিস্থিতির জন্যই কি দিদিমণি মোদীর কাছে গেলেন?” প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীরও কটাক্ষ, “ঈশান কোণে নানা মেঘ! তাই মমতার দিল্লি সফর!’’
তৃণমূল প্রত্যাশিত ভাবেই বিষয়টিকে রাজ্যের উন্নয়নের স্বার্থে দৌত্য হিসেবেই প্রচার করছে। মোদী-মমতা বৈঠক নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দফতর আজ যে দীর্ঘ বিবৃতি দিয়েছে, তাতে ঋণ মকুবের বিষয়টি না থাকলেও একশো দিনের কাজ ও নগরোন্নয়ন প্রকল্পে বকেয়া টাকা এ মাসেই মিটিয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে থমকে যাওয়া রেলপ্রকল্পগুলি ফের সচল করার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। মমতা এবং তাঁর সাংসদ বাহিনীর উদ্দেশে মোদী বলেছেন, ‘আমার উপর ভরসা রাখুন। দেশের পূর্বাঞ্চলকে শক্তিশালী করাটা আমার সরকারের ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতির মধ্যে পড়ে। আর কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গ শক্তিশালী না হলে দেশের পূর্বাংশের কখনওই উন্নতি হবে না।’ গঙ্গার পাশ্ববর্তী এলাকার মানুষের কৃষি ও জীবনযাপনের উন্নয়নের জন্যও একটি নির্দিষ্ট পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। যথাসময়ে তা রূপায়িত হবে বলে প্রধানমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন।
সূত্রের খবর, মোদী আজ মমতাকে জানিয়েছেন, তিনি যখন গুজরাতে মুখ্যমন্ত্রিত্বের ভার গ্রহণ করেছিলেন তখন তাঁকেও আগের সরকারের ঋণের দায় ঘাড়ে নিতে হয়েছিল। আবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পরেও তাঁর উপর ঋণের চাপ একই রকম। তৃণমূল সূত্রের বক্তব্য, মমতা প্রধানমন্ত্রীকে বুঝিয়ে বলেছেন, রাজ্য উত্তরোত্তর একটা ঋণের ফাঁদে জড়িয়ে পড়েছে। গত তিন বছরে ৮২ হাজার কোটি টাকারও বেশি ধার করেছে রাজ্য, যার মধ্যে ৭৬ হাজার কোটিরও বেশি গিয়েছে শুধু সুদ মেটাতে। পশ্চিমবঙ্গ যাতে আয় বাড়িয়ে এই ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসতে পারে তার চেষ্টা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন মোদী। জানিয়েছেন, কয়লা খনির নিলামের টাকায় কেন্দ্র হাত দিচ্ছে না। তা এখন রাজ্যের ঘরেই যাবে। রাজ্য থেকে আদায় হওয়া কেন্দ্রীয় করের ৪২ শতাংশ রাজ্যকেই ফেরত দেওয়া হবে। সেই সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের প্রাপ্য রাজস্বের ভাগ ৭.২৬৪% থেকে বাড়িয়ে ৭.৩২৪% করা হয়েছে। এর পাশাপাশি চতুর্দশ অর্থ কমিশনের অনুদান মিলিয়ে আগামী পাঁচ বছরে পশ্চিমবঙ্গ মোট ৩ লক্ষ ২৪ হাজার কোটি টাকা পাবে। গত পাঁচ বছরে যা ছিল, ১ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা।
দু’দফায় বৈঠকের পর মমতা সাংবাদিকদের বলেন, “প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছি আগের সরকারের নেওয়া ২ লক্ষ কোটি টাকারও বেশি ঋণের বোঝা আমার সরকারকে বইতে হচ্ছে। রাজ্যের রাজস্ব সংগ্রহের অধিকাংশটাই কেন্দ্রীয় ঋণ ও তার উপর সুদ মেটাতে চলে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছি, যাতে ঋণ মকুব করে রাজ্যকে আর্থিক ভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়।” মমতার দাবি, এই পরিস্থিতিতেও আর্থিক শৃঙ্খলা আইন চালু করে পশ্চিমবঙ্গ যে ঠিক পথে চলছে তা প্রধানমন্ত্রীর কথা থেকে স্পষ্ট। মুখ্যমন্ত্রীর দাবি, প্রধানমন্ত্রী রাজ্যের প্রশংসাই করেছেন। তা হলে রাজ্য বিজেপি যে প্রতি পদে মমতার সরকারকে আক্রমণ করে চলেছে, মোদী কি তার সঙ্গে সহমত নন? এ বিষয়ে বিজেপি রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের বক্তব্য, “ভারতের সংস্কৃতি হল অতিথি ঘরে এলে তাঁকে তারিফ করা। নিমন্ত্রণ খেতে গেলে রান্না খারাপ হলেও আমরা বলি না।” রাহুলবাবুর দাবি, প্রধানমন্ত্রীও তাই-ই করেছেন!