বার্নপুরের ইস্কো কারখানা।
কারখানার চিমনি থেকে ধোঁয়া না দেখতে পেয়ে কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগ নিয়ে কপালে ভাঁজ পড়েছিল। ইস্কোয় আধুনিকীকরণ প্রকল্প রূপায়ণের পরে তাই মুখে হাসি ফুটছে শিল্পাঞ্চলবাসীর। বণিক মহলের আশা, এই কারখানা ফুলেফেঁপে উঠলে জোয়ার আসবে অনুসারী শিল্পেও। সুফল পাবে হোটেল, আবাসনের মতো নানা ব্যবসাও।
ইস্কো সূত্রে জানা গিয়েছে, কারখানার আধুনিকীকরণের সিদ্ধান্তের পরেই কর্তৃপক্ষের প্রথম লক্ষ্য ছিল স্থানীয় বেকারদের কারিগরি শিক্ষা দিয়ে নানা শিল্পে কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেওয়া। প্রকল্পের কাজ শুরুর বছরখানেকের মধ্যে সেই উদ্যোগ শুরু হয়। খোঁজ নিয়ে জানা গিয়েছে, এলাকার জমিদাতা পরিবারগুলির প্রায় ১৭৭ জন বেকার যুবককে এক থেকে তিন বছরের কারিগরি প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এই রকমই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যুবক পুরুষোত্তমপুরের বাসিন্দা নীলকন্ঠ রায় বলেন, ‘‘আমি ওয়েল্ডার বিভাগে ১২ মাসের প্রশিক্ষণ নিয়েছি। মাসে ২০০০ টাকা করে ভাতাও পেয়েছি। প্রশিক্ষণ নিয়ে লাভ হয়েছে। এখন নিজে রোজগার করছি।’’ একই অভিজ্ঞতার কথা শুনিয়েছেন এলাকার আরও কিছু যুবক। ইস্কো কর্তৃপক্ষের দাবি, ইতিমধ্যে কয়েকশো যুবককে কারিগরি পদে বহাল করা হয়েছে। তবে এলাকার প্রশিক্ষিত যুবকদের এখনও নিয়োগ না করায় অনেকে ক্ষুন্ন। স্থানীয় বাসিন্দা বিনয় রায় যেমন বলেন, ‘‘গ্রামের জমিদাতা পরিবারগুলির ছেলেদের চাকরি হলে ষোলো কলা পূর্ণ হবে।’’
আসানসোলের পোলো মাঠে প্রধানমন্ত্রীর সভার নিরাপত্তা ব্যবস্থা খতিয়ে দেখল সেনাবাহিনীর কপ্টার। বৃহস্পতিবার।
বণিক মহলের মতে, ইস্কো ঘুরে দাঁড়ানোয় বাজারে অর্থের জোগান বেড়েছে। ফেডারেশন অব সাউথ বেঙ্গল চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সাধারণ সম্পাদক রাজেন্দ্রপ্রসাদ খেতান বলেন, ‘‘ইস্কোর আধুনিকীকরণের ফলে আমরা হাতের মুঠোয় চাঁদ পেয়েছি। কেন্দ্র ও রাজ্যের যৌথ চেষ্টায় এখানে ফের শিল্পায়নের জোয়ার শুরু হয়েছে। লাভ হচ্ছে শিল্প ও ব্যবসায়ী মহলের।’’ তবে তিনি আক্ষেপ করেন, এখানকার ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের অগ্রগতিতে ইস্কো আশানুরূপ সাহায্য করতে পারেনি। তাঁদের দাবি, ইস্পাত সহায়ক এলাকার অনুসারী শিল্প সংস্থাকে আরও বেশি কাজের বরাত দিতে হবে। তাহলে শিল্প মালিকদের সঙ্গে আর্থিক লাভবান হবেন সংস্থার শ্রমিকেরাও। বণিকসভার আশা, উৎপাদন পুরোমাত্রায় চালু হলে ইস্কোর চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের এই দাবিও পূরণ হবে। ইস্কো সূত্রে জানা গিয়েছে, এলাকার প্রায় ১৭টি অনুসারী শিল্প সংস্থার নাম নথিভুক্ত করা হয়েছে। সংস্থার চাহিদা মতো তারা বরাত পাবে। আসানসোল ইন্ডাস্ট্রিয়াল চেম্বারের সভাপতি অধীর গুপ্ত দাবি করেন, ইস্কোয় আধুনিকীকরণ ও বিনিয়োগের ফলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের তেমন উন্নতি না হলেও বাজারে আর্থিক জোগানের পরোক্ষ প্রভাব পড়েছে।
শিল্পাঞ্চলের হোটেল ও রিয়েল এস্টেটের ব্যবসা তুলনামূলক ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে বলে জানান আবাসন শিল্পের সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ীরা। তাঁদের যুক্তি, প্রকল্পের কাজে জড়িত প্রচুর দেশি-বিদেশি সংস্থার আধিকারিক ও শ্রমিক-কর্মী আট বছর ধরে এখানে বাস করেছেন। আসানসোল রিয়েল এস্টেট ডেভেলপার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান উপদেষ্টা শচীন রায় বলেন, ‘‘যে সংস্থা বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল সেটি এ ভাবে ঘুরে দাঁড়ানোয় আমরা খুশি। এর সুফল আমরাও পেয়েছি।’’ আবাসন শিল্পে যুক্ত ব্যবসায়ীরা জানান, আট বছর আগে যে শহরে বহুতলের সংখ্যা ছিল হাজারখানেক, তা এখন বেড়ে হয়েছে প্রায় আট হাজার। ইস্কোয় সুদিন ফেরা এর অন্যতম কারণ বলে মনে করেন তাঁরা। লোকজনের আনাগোনা বাড়ায় দোকান-বাজারে লেনদেনও আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা। বার্নপুরের বস্ত্র ব্যবসায়ী ভক্ত দত্তের কথায়, ‘‘শিল্পে অগ্রগতিতে আয়ের পথ সুগম হচ্ছে, কেনাকাটাও বাড়ছে।’’
ইস্কোর সম্প্রসারণ প্রক্রিয়ায় নানা সামাজিক সমস্যারও সুরাহা হচ্ছে। কারখানা কর্তৃপক্ষের দাবি, বেশ কয়েকটি গ্রাম দত্তক নিয়ে সামাজিক উন্নয়ন করা হয়েছে। অনেক গ্রামের ক্রীড়া-সংস্কৃতির উন্নয়ন থেকে বাসিন্দাদের চিকিৎসা, নানা ব্যবস্থা হয়েছে। পুকুর খনন, পানীয় জল সরবরাহ থেকে চাষযোগ্য জমিতে সেচের ব্যবস্থা হয়েছে। বহু গ্রামে কমিউনিটি সেন্টার গড়ে দেওয়া হয়েছে। নতুন করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবন গড়ে দেওয়া হয়েছে। ইস্কোর সম্প্রসারণ প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণের সময় বিভিন্ন দাবি দাওয়া আদায়ে আন্দলন করেছিল ‘পুরুষোত্তমপুর-নাকরাসোতা ল্যান্ড লুজার্স কমিটি’। তার সম্পাদক চন্দ্রশেখর রায় বলেন, ‘‘আমাদের দাবি মেনে নাকরাসোতা গ্রামের সারমারা প্রাথমিক বিদ্যালয়টি নতুন করে তৈরি করে দিয়েছে ইস্কো। পুরুষোত্তমপুর গ্রামে কয়েক একর খাস জমিতে একটি পুকুরও কেটে দিয়েছে।’’ তবে প্রশিক্ষণ নেওয়া এলাকার বেকার যুবকদের এখনও চাকরি না হওয়া নিয়ে অসন্তোষ জানান তাঁরা।
শিল্পাঞ্চলবাসী অবশ্য বলছেন, সবে তো শুরু। কয়েক বছরে নিশ্চয় আরও সুফল মিলবে।
ছবি: শৈলেন সরকার।