কেশপুরের বাঁশগেড়িয়ায় জনসংযোগ বিমান বসুর। ছবি: রামপ্রসাদ সাউ।
সুন্দর মুখ দেখে মনোরঞ্জন হয়। কিন্তু ভোট দেওয়া যায় না। ভোটের ময়দানে ব্যক্তি নয়, নীতিই হল বড় কথা। শুক্রবার একথা ফের মনে করিয়ে দিলেন বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু। আর এ বার মনে করালেন ঘাটাল লোকসভা কেন্দ্রে তৃণমূলের তারকা প্রার্থী দেবের গ্রাম কেশপুরের মহিষদায় গিয়ে।
বৃহস্পতিবারই মহিষদায় গিয়েছিলেন দেব। ভোটে দাঁড়ানোর পরে গ্রামের বাড়িতে এটাই ছিল তাঁর প্রথম যাওয়া। জেঠু তথা সিপিএমের কেশপুর জোনাল কমিটির সদস্য শক্তিপদ অধিকারী ও তৃণমূল বিধায়ক শঙ্কর দোলুইকে পাশে নিয়ে জনসংযোগও শুরু করে দেন দেব। পরদিন সে গ্রামেই ঘাটাল লোকসভা কেন্দ্রের প্রার্থী সন্তোষ রাণাকে সঙ্গে নিয়ে হাজির হন বিমানবাবু। সঙ্গে ছিলেন সিপিআইয়ের রাজ্য সম্পাদক মঞ্জু কুমার মজুমদার, ঘাটাল লোকসভা কেন্দ্রেরই সাংসদ গুরুদাশ দাশগুপ্ত-সহ বামফ্রন্ট নেতৃত্ব। যেখানে উপস্থিত ছিলেন দেবের জেঠু শক্তিপদবাবুও। দেবের বাড়ি থেকে ২০০ মিটার দুরের ছোট্ট মাঠেই মাইক ছাড়া এক ক্ষুদ্র সভারও আয়োজন করা হয়। সেখানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বিমানবাবু দলীয় প্রার্থী সন্তোষ রাণাকে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। তারপরই জনগণের উদ্দেশ্যে বিমানবাবুর প্রশ্ন, “কেন ওঁকে দেখালাম বলুন তো?” উত্তরও দেন নিজেই, “দেখালাম উনি কেমন দেখতে, সে জন্য না। দেখতে কালো, শ্যামবর্ণ না ফর্সা এটা বড় কথা নয়। উনি কী করেন সেটা বড় কথা। উনি রাজনীতি করেন। শ্রমিক-কৃষকের যন্ত্রণার জন্য লড়াই করেন। দুনিয়ার মজদুর এক হও বলে স্লোগান তোলেন। তাই সুন্দর মুখের অভিনয় দেখুন, আনন্দ করুন। আর ভোট দেওয়ার সময় ভাববেন, এই লড়াই ব্যক্তির লড়াই নয়, নীতির লড়াই।”
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, যেদিন দেব নিজের জন্ম ভিটের গেলেন ঠিক তার পরদিনই বামফ্রন্ট নেতৃত্ব ওই গ্রামেই গেলেন কেন? সিপিএমের শক্ত ঘাঁটি বলে পরিচিত মহিষদারও ভোট কী তাহলে গ্রামের তারকা ছেলে দেবের দিকে যাওয়ার আশঙ্কা করছে সিপিএম। মাত্র ২৪ ঘন্টার ব্যবধানে দুই মেরুর মানুষকে কী ভাবে অভ্যর্থনা জানাল মহিষদা। ‘দেব’কে দেখতে গ্রামের যুবকদের বাঁধ ভাঙা উচ্ছ্বাস ছিল নজরকাড়া। তবে কারও হাতে দলীয় পতাকা ছিল না। এ দিন বামফ্রন্ট নেতৃত্বকে অভ্যর্থনা জানাতে গ্রামে ঢোকার রাস্তার দু’ধারে হাতে পতাকা নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন প্রায় শ’খানেক কর্মী-সমর্থক। বিমানবাবু অবশ্য ২৪ ঘন্টার ব্যবধানে দুই দলের প্রার্থীর যাওয়াকে নিতান্তই কাকতলীয় বলে ব্যাখ্যা করতে চাইছেন। দেবকে উদ্দেশ্য করেও তিনি সুন্দর মুখ বা অভিনেতার কথা তোলেননি বলেও দাবি করেন। তাঁর কথায়, “আমাদের কর্মসূচি অনেক আগে থেকেই ঠিক ছিল। আর আমি যে কথা বলেছি নির্দিষ্ট কাউকে উদ্দেশ্য করে নয়, সব ক্ষেত্রেই এটা প্রযোজ্য।”
অভিনেতা দেবের গ্রাম কেশপুরের মহিষদায় বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু। বৃহস্পতিবারই।
সিপিএম নেতার বাড়িতে দেব এর আগমনে নির্বাচনে কোনও প্রভাব পড়বে না? বিমানবাবুর কথায়, “না। আমি এক সময় কংগ্রেস সমর্থকের বাড়িতে ভাড়া থাকতাম। কিন্তু আমি তো বামপন্থী রাজনীতিই করি।”
এ দিন কেশপুর থানা এলাকার চারটি গ্রামে যান বামফ্রন্টের প্রতিনিধি দল। গত শনিবার কেশপুরের বিভিন্ন গ্রামে পতাকা তোলে সিপিএম। মিছিলও করে। তারপর থেকেই বিভিন্ন গ্রামে তৃণমূল সন্ত্রাস করছে বলে অভিযোগ। এমনকি বাড়ি ভাঙচুরেরও অভিযোগ রয়েছে। ফলে অনেকেই ভয়ে গ্রামে থাকতে পারছেন না। তা সরেজমিনে খতিয়ে দেখতেই বামফ্রন্টের প্রতিনিধি দল এদিন কেশপুরে আসেন। প্রথমেই কেশপুরের দলীয় কার্যালয় জামসেদ আলি ভবনে ঘরছাড়াদের সঙ্গে কথা বলেন। তারপর সোজা চলে যান বাঁশগেড়িয়া গ্রামে। যেখানে বেশ কয়েকটি বাড়ির ছাউনি এখনও ভাঙা। গ্রামের বাসিন্দা নমিতা কুইলা, রাজাবালা কুইলারা বলেন, “তৃণমূলের লোকজন রাতের অন্ধকারে এসে বাড়ি ভেঙেছে। ভাতের হাঁড়িতে প্রস্রাবও করে দিয়ে গিয়েছে!” কবিতা কুইলার কথায়, “আগে স্বামী কংগ্রেস করত বলে সিপিএম মারধর করত। তারপর থেকে সিপিএম হয়েই ছিলাম। এবার তৃণমূল মারধর করছে। বলতে তৃণমূল হতে হবে। বাড়ি ভাঙচুর করে ঘরে তালা লাগিয়েও চলে গিয়েছিল তৃণমূল। বাচ্চা বাচ্চা ছেলেগুলোকে খেতে পর্যন্ত দিতে পারিনি। ভয়ে ছেলেদের বাপের বাড়িতে রেখে এসেছি।”
বাঁশগেড়িয়ার পর গোপীনাথপুর ও কলাগ্রাম যান বামফ্রন্ট নেতৃত্ব। সর্বত্রই ছোট্ট ছোট্ট করে সভার আয়োজন ছিল। নেতারা যেতেই গ্রামের বাসিন্দারা জানান, “গুলি চালাচ্ছে, বোমা ফাটাচ্ছে। এভাবে কী থাকা যায়। আপনারা আমাদের বাঁচান। আপনারা চলে গেলেই ফের রাতে হামলা করবে।” অভিযোগ, পুলিশ ও তৃণমূল এক যোগে গ্রামে গ্রামে হামলা চালাচ্ছে। বিমানবাবু তাঁদের বলেন, “মানুষ সমাজবদ্ধজীব। যাঁরা অমানুষ তাঁরাই এমন কাজ করে। একই সমাজে থাকা মানুষ যার যা পছন্দ তিনি সেই পার্টি করতে পারেন। আসলে তৃণমূল ভয় পেয়েছে, তাই সন্ত্রাস করছে। সকলকে জোট বেঁধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে থাকতে হবে। প্রতিটি মানুষের ঘরে ঘরে যেতে হবে। যাঁরা কোনও পার্টি করে না তাঁদের ঘরেও যেতে হবে।”
পরে জামশেদ আলি ভবনে সাংবাদিক বৈঠকও করেন তিনি। বলেন, “কী ভাবে অত্যাচার করছে তা খতিয়ে দেখতেই এসেছিলাম। পুলিশও নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করছে না। আমরা সমস্ত অভিযোগ রাজ্য নির্বাচন কমিশনকে জানিয়েছি। ১ এপ্রিল দিল্লিতে কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনকেও এ ব্যাপারে স্মারকলিপি দেব।”
কয়েক বছর আগেও বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে তৃণমূল যে সন্ত্রাসের অভিযোগ করত এখন বামফ্রন্ট তৃণমূলের বিরুদ্ধে একই অভিযোগ করছে। দুইয়ের মধ্যে ফারাক কোথায়? পরোক্ষে বামফ্রন্টও একদলীয় শাসন কায়েম করত একথা স্বীকার করে নিয়েই বিমানবাবুর জবাব, “তখন যদিও কিছু হয়েছে তা অতি সামান্য। এখন বেশি হচ্ছে। মনোনয়ন জমা দেওয়ার সময় থেকেই সন্ত্রাস শুরু হয়ে যাচ্ছে।”
ছবি: রামপ্রসাদ সাউ।