খড়্গপুরের হিজলি কলেজের গেটে পুলিশ পাহারা। টিএমসিপি-র সঙ্গেই উড়ছে এবিভিপি-র পতাকা । ছবি: রামপ্রসাদ সাউ।
থমথমে পরিবেশে, বিক্ষিপ্ত অশান্তি দিয়েই পশ্চিম মেদিনীপুরে ছাত্রভোটের মনোনয়নপর্ব শুরু হল শুক্রবার। সকাল থেকেই কলেজগুলোর সামনে জোরদার পুলিশ পাহারা ছিল। সাদা পোশাকের পুলিশও কলেজের আশপাশে নজরদারি চালিয়েছে। কলেজে কলেজে প্রচুর পুলিশ মোতায়েন থাকায় বড়সড় গোলমাল এড়ানো গিয়েছে।
কেমন ছিল পুলিশি নজরদারি?
পশ্চিম মেদিনীপুরের যে সব কলেজে ছাত্রভোট নিয়ে অশান্তির আশঙ্কা রয়েছে, তার মধ্যে শহরের কমার্স কলেজ অন্যতম। শুক্রবার সকাল থেকে কলেজ সংলগ্ন এলাকা কার্যত পুলিশে মুড়ে ফেলা হয়। প্রায় জনা পঞ্চাশেক পুলিশ কর্মী মোতায়েন ছিলেন। ছিল সাদা পোশাকের পুলিশের নজরদারিও। কলেজের সামনে ছিলেন তিন জন ডিএসপি পদমর্যাদার অফিসার। কয়েক জন এসআই-এসএসআই ছিলেন। কলেজ চত্বরের একশো মিটারের মধ্যে ১৪৪ ধারা জারি করাও হয়।
জেলা পুলিশের এক কর্তা জানাচ্ছেন, কোন কোন কলেজ উত্তেজনাপ্রবণ, তার তালিকা আগেই ঠিক ছিল। সেই মতোই পুলিশ মোতায়েন করা হয়। যে সব কলেজে অশান্তির আশঙ্কা রয়েছে, সেখানে বাড়তি পুলিশ মোতায়েন করা হয়। তার ফলেই খড়্গপুর মহকুমার হিজলি কলেজ, খড়্গপুর কলেজ, ডেবরা ক্ষুদিরাম মহাবিদ্যালয়, সবং সজনীকান্ত মহাবিদ্যালয়, দাঁতন ভট্টর কলেজ, পিংলা কলেজে শান্তির আবহেই কিছু মনোনয়ন জমা পড়েছে। সাধারণত, ভোটের দিন পুলিশ মোতায়েন থাকে। তবে মনোনয়নপর্বে কলেজের আশপাশ যে এ ভাবে পুলিশ দিয়ে মোড়া থাকবে, তা ভাবতে পারেননি অনেকেই। কলেজের অদূরেই বাড়ি সৌরভ ঘোষের। পেশায় আইনজীবী সৌরভের কথায়, “এ দিন পাড়ায় প্রচুর পুলিশ ছিল। কোনও অশান্তি হয়নি, এটা ভালই।”
থমথমে পরিবেশের গেরোয় এ দিন কলেজগুলিতে পঠনপাঠন শিকেয় ওঠে। অশান্তির আশঙ্কায় নামমাত্র ছাত্রছাত্রী কলেজে এসেছিলেন। কমার্স কলেজে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা প্রায় ১,৪০০। এ দিন কলেজে ছিলেন মেরেকেটে জনা ষাটেক! কোনও ক্লাসে দু’জন, তো কোথাও ৪ জন!
বিরোধী ছাত্র সংগঠনগুলোর অবশ্য অভিযোগ, পুলিশ পাহারা সত্বেও পশ্চিম মেদিনীপুরের বিভিন্ন কলেজের সামনে, ভিতরে টিএমসিপি জমায়েত করেছে। মনোনয়ন তুলতে গেলেই তাদের বাধা দেওয়া হয়েছে। কোথাও কোথাও হামলাও হয়েছে। কলেজ কর্তৃপক্ষ এবং পুলিশের কাছে অভিযোগ জানিয়েও সুরাহা হয়নি। টিএমসিপি-র পাল্টা দাবি, খাস মেদিনীপুর শহরে তারা আক্রান্ত হয়েছে। সংগঠনের দুই কর্মীকে মারধর করেছে এবিভিপি। অভিযোগ উড়িয়ে এবিভিপি জানিয়েছে, ঘটনাটি টিএমসিপি-র গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জের।
দুই মেদিনীপুরের অধীন কলেজগুলোর ছাত্র সংসদ নির্বাচনের মনোনয়নপর্ব শুরু হয়েছে শুক্রবার থেকেই। চলবে আজ, শনিবার পর্যন্ত। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে মনোনয়নপর্ব চলবে ২১ জানুয়ারি পর্যন্ত। মনোনয়ন জমা দিতে হবে শেষ দু’দিনে অর্থাৎ ২০ এবং ২১ জানুয়ারি। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, সুষ্ঠু ভাবে ছাত্র সংসদ নির্বাচন করতে প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপই করা হয়েছে।
তবুও বিচ্ছিন্ন ভাবে কিছু কলেজে গোলমাল ঠেকানো যায়নি। এবিভিপি-র দাবি, বেলদা কলেজে তাঁদের প্রার্থীদের বাধা দিয়েছে টিএমসিপি। দুপুর দেড়টা নাগাদ মনোনয়ন জমা দিতে আসেন প্রার্থীরা। তাঁদের অভিযোগ, মনোনয়ন জমা দেওয়ার লাইন থেকে তাঁদের জোর করে বের করে দিয়েছে টিএমসিপি-র ছেলেরা। কলেজ শাখার এবিভিপি-র সভাপতি সৌমেন দাসের অভিযোগ, “পুলিশ এবং অধ্যক্ষকে বিষয়টি জানানো হলেও গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।”
অভিযোগ উড়িয়ে কলেজের টিএমসিপি-র নেতা সুমন চন্দের প্রতিক্রিয়া, প্রার্থী না পেয়ে মিথ্যে অভিযোগ তুলছে এবিভিপি। অধ্যক্ষ মানবেন্দ্র মণ্ডল বলেন, “একটি ছাত্র সংগঠনের থেকে অভিযোগ পেয়ে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে মনোনয়ন জমা নিয়েছি। কোনও অশান্তি কিংবা বিশৃঙ্খলা হয়নি।” গণ্ডগোলের জেরে এ দিন আর মনোননয়ন জমা দেয়নি এবিভিপি। ডিএসও-র জেলা সম্পাদক মণিশঙ্কর পট্টনায়কেরও বলেন, “বেলদা কলেজে হামলা হয়েছে। অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে ছাত্র সংসদের ক্ষমতা কুক্ষিগত করার প্রয়াসই চলেছেই।”
খড়্গপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার অভিষেক গুপ্ত বলেন, “সব কলেজে শান্তিপূর্ণ ভাবে প্রথম দিনের মনোনয়ন মিটেছে। বেলদা কলেজে লাইন থাকায় তিনটের পরও মনোনয়ন চলে।” কলেজে কোনও অশান্তি কথা জানা নেই, দাবি তাঁর।
বিরোধীদের দাবি, জেলার বহু কলেজেই টিএমসিপি দাদাগিরি দেখিয়েছে। এসএফআইয়ের জেলা সম্পাদক সৌগত পণ্ডা বলেন, “চন্দ্রকোনা রোড, চন্দ্রকোনা টাউনে টিএমসিপি সংগঠনের কর্মী-সমর্থকদের মেরে তাড়িয়ে দিয়েছে। রোডে কর্মীদের সাইকেল ভেঙে দিয়েছে। গোপীবল্লভপুর-সহ বেশ কিছু কলেজে অশান্তি করেছে।” এবিভিপি-র জেলা পর্যবেক্ষক অসীম মিশ্র বলেন, “গড়বেতা, বেলদা-সহ কয়েক’টি কলেজে কর্মী-সমর্থকেরা মনোনয়ন জমা দিতে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে তাঁদের বের করে দেওয়া হয়েছে। কলেজে কলেজে বহিরাগতদের নিয়ে টিএমসিপি জমায়েত করেছে।” ছাত্র পরিষদের জেলা সভাপতি মহম্মদ সইফুল বলেন, “বেশ কিছু কলেজে টিএমসিপি সন্ত্রাসের পরিবেশ তৈরি করেছিল। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে যে পরাজয় নিশ্চিত, সেটা ওরা বুঝে গিয়েছে।”
টিএমসিপি-র অবশ্য অভিযোগ, মেদিনীপুর কমার্স কলেজের সামনে তাদের কর্মীদের উপর এবিভিপি হামলা চালিয়েছে। কেমন? টিএমসিপির জেলা সাধারণ সম্পাদক বুদ্ধ মণ্ডলের অভিযোগ, “দুই কর্মীকে মারধর করা হয়েছে। বেশ কিছু মনোনয়ন ছিঁড়ে দেওয়া হয়েছে।” একধাপ এগিয়ে টিএমসিপির জেলা সভাপতি রমাপ্রসাদ গিরি বলেন, “এ দিন আমার বাড়িতেই এবিভিপির এক দল কর্মী হামলা চালিয়েছে। এক কর্মীর বাইকও ভেঙে দেওয়া হয়েছে। পুরো ঘটনাই পুলিশকে জানিয়েছি।”
অভিযোগ উড়িয়ে এবিভিপির জেলা সভাপতি স্বরূপ মাইতি বলেন, “কমার্স কলেজের সামনে প্রচুর পুলিশ ছিল। তার মধ্যেই টিএমসিপি কর্মীরা কী ভাবে আক্রান্ত হলেন বুঝতে পারছি না।” কমার্স কলেজের ছাত্র সংসদ সিপির দখলে ছিল। সিপির জেলা সভাপতি-র মন্তব্য, কমার্স কলেজে প্রার্থী খুঁজে না পেয়ে টিএমসিপি আক্রান্ত সাজছে। অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগে সরগরম জেলার ছাত্র রাজনীতি। প্রথম দিনের পরীক্ষায় জেলা পুলিশ উতরে গেলেও, আজ শনিবারের পরীক্ষায় ফল কী হয় দেখার সেটাই!