নালন্দা মহাবিহারে তখন শেষ কয়েকটি দিন কাটাচ্ছেন জুয়ান জ্যাং বা হিউয়েন সাং। এক রাতে আচমকা দুঃস্বপ্নে দেখলেন মহাবিহার ভেঙে পড়েছে। ছাত্র-শিক্ষক কারও দেখা নেই। ঘরগুলি ফাঁকা। উদ্বেগে অস্থির হয়ে বালাদিত্য মন্দিরের উপরে চলে গেলেন তিনি। সেখানে অন্ধকারের মধ্যে হঠাৎ দেখলেন সামনে দাঁড়িয়ে মঞ্জুশ্রী। আঙুল তুলে দেখাচ্ছেন, একটা বিরাট অগ্নিবলয় ঘিরে ফেলছে মহাবিহারটি। ওই অগ্নি প্রতীকী। অন্তত তেমনই মনে করেছিলেন জুয়ান জ্যাং। মঞ্জুশ্রী বোঝাতে চেয়েছিলেন, বৌদ্ধ ধর্ম এবং ওই মহাবিহার বিরাট বিপদের মুখে পড়তে চলেছে, তাই চিন থেকে আসা পরিব্রাজক দার্শনিক জুয়ান জ্যাংয়ের এ বার ভারত ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় হয়েছে। সম্বিৎ ফিরে পেয়ে চোখ তুলে তাকাতেই জুয়ান জ্যাং দেখলেন বিরাট পুরুষ মঞ্জুশ্রী পিছন ফিরে মিলিয়ে যাচ্ছেন মহাবিহারের ‘ধ্বংসস্তূপে’র মধ্যে। তাঁর ভ্রমণ বৃত্তান্তে এই বিবরণ দিয়েছেন জুয়ান জ্যাং নিজেই।
বৌদ্ধধর্মের একটি ধারা বজ্রযানে মঞ্জুশ্রী প্রজ্ঞার দেবতা এবং বোধিসত্ত্বের এক রূপ। সেখানে মঞ্জুশ্রী আদি বুদ্ধর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। আদি বুদ্ধ এক নিরাকার দেবতা। তাঁর পরে রয়েছেন পাঁচ ধ্যানী বুদ্ধ। তাঁরা মগ্ন থাকেন ধ্যানেই। তাঁদের আধ্যাত্মিক পুত্র পাঁচ বোধিসত্ত্ব। তাঁদেরই অন্যতম হলেন অবলোকিতেশ্বর ও মঞ্জুশ্রী। অবলোকিতেশ্বর করুণার দেবতা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পালি বিভাগের অধ্যাপিকা ঐশ্বর্য বিশ্বাস বলেন, “তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্মে অবলোকিতেশ্বরই প্রাধান্য পেতেন, পরে সেই স্থান নিয়ে নেন মঞ্জুশ্রী।” বিহারগুলিতে মঞ্জুশ্রী ছিলেন অন্যতম প্রধান উপাস্য। মঞ্জুশ্রীর মূর্তিও থাকত সেখানে।
জুয়ান জ্যাং সপ্তম শতাব্দীতে ভারতে এসেছিলেন। তারই সমসাময়িক মোগলমারির দু’টি মহাবিহারের দেওয়ালের অলঙ্করণেও মঞ্জুশ্রীর খোঁজ মিলেছে বলে মনে করেন পুরাতত্ত্ববিদেরা। ষষ্ঠ থেকে একাদশ শতক পর্যন্ত এই দু’টি মহাবিহারই বৌদ্ধ বিদ্যাচর্চার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। স্বয়ং জুয়ান জ্যাং তাম্রলিপ্ত বন্দরের কাছাকাছি যে বিহারগুলির উল্লেখ করেছিলেন, এই দু’টি মহাবিহার তার অন্যতম বলেও মনে করা হয়। তাই তাতে মঞ্জুশ্রীর মূর্তি থাকা মোটেই অস্বাভাবিক নয়।
মঞ্জুশ্রী মূর্তির অন্যতম প্রধান চিহ্ন হল তার গলার বাঘনখ এবং হাতের তলোয়ার। কোথাও কোথাও মঞ্জুশ্রীর হাতে থাকে প্রজ্ঞাপারমিতার পুথিও। দীর্ঘনাসা মঞ্জুশ্রী রূপবান যুবক। তবে মোগলমারির মূর্তিটির মুখটি ভেঙে গিয়েছে। এই দ্বিভুজ মঞ্জুশ্রীর বাঁ হাতে একটি তলোয়ার। যা থেকে আলো বেরিয়ে অজ্ঞানতার অন্ধকার দূর করে। ডান হাতে তিনি বরদান করছেন। অনাবৃত ঊর্ধ্বাঙ্গে রাজকীয় নানা অলঙ্কার। গলায় বাঘনখ। তবে পুথিটি এ ক্ষেত্রে নেই। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীন ভারতের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপিকা সুদীপা রায় বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “মঞ্জুশ্রীর অনেক রূপ। স্থান-কাল ভেদে তাঁর রূপের পরিবর্তনও ঘটে। তবে গলায় বাঘনখ ও তলোয়ার প্রায় সব ক্ষেত্রেই দেখা যায়। ডান হাতে বরদান করছেন, এমনটাও তাঁর খুবই পরিচিত ভঙ্গি।”
মোগলমারিতে মঞ্জুশ্রীর মূর্তিটি পাওয়া গিয়েছে বিহারের দেওয়ালে। চুন-বালির মণ্ড দিয়ে তৈরি করা হত বিহারের ইটের দেওয়ালের অলঙ্করণগুলি। যাকে বলা হয় স্টাকোর কাজ। সম্প্রতি এই মহাবিহার দু’টি উৎখনন করেছেন রাজ্য পুরাতত্ত্ব দফতরের উপ-অধিকর্তা অমল রায়। তিনি বলেন, “দেওয়ালে যে স্টাকোর কারুকাজের সন্ধান মিলেছে, তার মধ্যে একটি মঞ্জুশ্রীর মূর্তি হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের মত।”
তবে জুয়ান জ্যাং তাঁর দুঃস্বপ্নে দেখা মঞ্জুশ্রীর আচরণের যে ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, ইতিহাস তা পুরোপুরি সমর্থন করে না। জুয়ান জ্যাং ভারত ছাড়ার কিছু দিন পরে পাল যুগেই মঞ্জুশ্রীর উপাসনা সব থেকে বেড়েছিল বলে মনে করেন ইতিহাসবিদেরা। মঞ্জুশ্রী গবেষক লরা হ্যারিংটনের বক্তব্য, সেই সময় থেকেই আঞ্চলিক সামন্ত রাজাদের প্রতিপত্তি বাড়তে শুরু করে। সেই রাজারা বৌদ্ধ বিহারগুলিকে জমি ও অনেক সময় স্থানীয় ভাবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষমতাও দান করতেন। বাংলায় বৌদ্ধ প্রভাবও বাড়ে এই সময়ে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতত্ত্ব দফতরের প্রাক্তন প্রধান রূপেন্দ্রকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেন, “নালন্দার সময়েই দক্ষিণ ও মধ্য বঙ্গে মোগলমারির মতো একাধিক বৌদ্ধ বিহারের উত্থান ঘটেছিল। সেক্ষেত্রে মোগলমারিতে নালন্দার উপাস্য মঞ্জুশ্রীর সন্ধান মেলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।” রত্নগিরি, উদয়গিরি ও ললিতগিরি অঞ্চলে আবিষ্কৃত বৌদ্ধ স্থাপত্য ও ভাস্কর্যেও মঞ্জুশ্রীর উপস্থিতি রয়েছে। নেপাল ও চিনে মঞ্জুশ্রী খুবই জনপ্রিয়। তাঁর অনেক ছবি সেখান থেকে পাওয়া গিয়েছে। নালন্দা ও জগজীবনপুরের মহাবিহারেও মঞ্জুশ্রী মূর্তি মিলেছে।