গোপীবল্লভপুরে সুবর্ণরেখার ভাঙন। ছবি: দেবরাজ ঘোষ।
ভোটের আগে ভাঙন-রোধে ভুরি ভুরি প্রতিশ্রুতি আর ভোট ফুরোলে সব প্রতিশ্রুতিই নদীর জলে! এমনই তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে বাস করছেন পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার জঙ্গলমহলের নদী তীরবর্তী এলাকার বাসিন্দারা। আর জঙ্গলমহলে নদী-ভাঙনের বিষয়টি অনিবার্যভাবে তৃণমূলের বিরুদ্ধে সিপিএম-সহ বিরোধীদের যুতসই প্রচারের অস্ত্র।
জঙ্গলমহলে সুবর্ণরেখা তীরবর্তী গোপীবল্লভপুর-১, গোপীবল্লভপুর-২, সাঁকরাইল ও নয়াগ্রাম ব্লক এবং কংসাবতী নদী তীরবর্তী ঝাড়গ্রাম ও বিনপুর ১ ব্লকের বিস্তীর্ণ এলাকায় নদী-ভাঙনের সমস্যা তীব্র আকার নিয়েছে। সেচ দফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত দশ বছরে জঙ্গলমহলে নদী-ভাঙন ও ভূমিক্ষয়ের ফলে প্রায় আড়াইশো হেক্টর উর্বর চাষ-জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গিয়েছে। প্রতি বছরই একটু একটু করে চাষের জমি ও জনপদ গ্রাস করছে সুবর্ণরেখা ও কংসাবতী। লালগড়ের কংসাবতী তীরবর্তী নেতাই গ্রামের ৯ বাসিন্দার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে বিধানসভা ভোটে অভূতপূর্ব সাফল্য পেয়েছিল তৃণমূল। সেই নেতাই গ্রামটিও ভাঙনে কবলে। অভিযোগ, ভাঙন-ঠেকাতে প্রতিশ্রুতি অনেক মিলেছে, কাজ কিছুই হয় নি। রাজ্য সরকারের তরফে ভাঙন-রোধে ঘোষণার তালিকাটি অবশ্য ভোটারের কাছে যথেষ্ট আশাপ্রদ। কিন্তু অভিযোগ, ঘোষণা ও বাস্তবের মধ্যে আসমান জমিন ফারাক।
ভোট-প্রচারে এই প্রসঙ্গেই তৃণমূলকে বিঁধছে সিপিএম ও অন্যান্য বিরোধী দলগুলি। লোকসভা নির্বাচন ঘোষণার আগে গত ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি জঙ্গলমহলে এসে সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন, তাঁদের সরকার ক্ষমতার আসার পরে মাত্র আড়াই বছরে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় নদী ভাঙন ও ভূমিক্ষয় রোধে ইতিমধ্যেই ১৮৫ কোটি টাকার কাজ হয়েছে। আরও জানান, সুবর্ণরেখা তীরবর্তী নয়াগ্রাম ব্লকের ৮টি মৌজা, গোপীবল্লভপুর-১ ব্লকের ১২টি মৌজা, গোপীবল্লভপুর-২ ব্লকের ২টি মৌজা এবং কংসাবতী নদীর তীরবর্তী ঝাড়গ্রাম ব্লকের ৪টি মৌজা ও বিনপুর-১ ব্লকের ২টি মৌজায় ভাঙন-রোধে কার্যকরী পদক্ষেপ করার জন্য সমীক্ষার কাজ হয়ে গিয়েছে। এ জন্য দেড়শো কোটি টাকা প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছে। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি গোপীবল্লভপুর-২ ব্লকের চোরচিতা গ্রামে সুবর্ণরেখা নদীর ভাঙন ও ভূমিক্ষয় রোধ প্রকল্পের শিলান্যাস করেছিলেন রাজীববাবু। চোরচিতায় ২৭০০ মিটার (২.৭ কিমি) দীর্ঘ নদীপাড় এলাকায় বোল্ডার দিয়ে ভাঙন ও ভূমিক্ষয় রোধ প্রকল্পের কাজ সবে শুরু হয়েছে। এ জন্য ৭ কোটি ৭১ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে।
নদী-ভাঙন-রোধে রাজ্য সরকারের এই পদক্ষেপকে অবৈজ্ঞানিক ও ভোটের চমক বলে দাবি করেছেন ঝাড়গ্রাম লোকসভা কেন্দ্রের প্রার্থী তথা দলের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য পুলিনবিহারী বাস্কে। পুলিনবাবুর কথায়, “জঙ্গলমহলের নদী-ভাঙনকে জাতীয় পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। এখানকার নদীগুলির ড্রেজিং করা দরকার। বর্তমান রাজ্য সরকার ভোটের চমক দিতে পরিকল্পনা বিহীন ভাবে কিছু ঘোষণা করেছে। চোরচিতার মতো গ্রামগুলিতে যে পদ্ধতিতে ভাঙন-ঠেকানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, তাতে সমস্যা আরও বাড়বে।” বিজেপির আদিবাসী মোর্চার রাজ্য সভাপতি তথা ঝাড়গ্রাম কেন্দ্রের দলীয় প্রার্থী বিকাশ মুদি বলেন, “রাজ্যের কোনও সরকারই জঙ্গলমহলের ভাঙন-রোধে কার্যকরী কিছু করে নি। প্রচারে গিয়ে বাসিন্দাদের ক্ষোভের আঁচটা টের পাচ্ছি।” কংগ্রেস প্রার্থী অনিতা হাঁসদার কথায়, “বাস্তবে নদী-ভাঙনের নামে পুরোটাই তৃণমূল সরকারের ভাঁওতাবাজি। কেন্দ্রীয় প্রকল্পের টাকা নয়ছয় করে জঙ্গলমহলে উন্নয়নের নামে ধাপ্পাবাজি চলছে।”
ঝাড়গ্রাম লোকসভা কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী উমা সরেন বলেন, “আমাদের মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে জঙ্গলমহলে উন্নয়ন যজ্ঞ চলছে। ৩৪ বছর রাজ্যের ক্ষমতায় থেকেও পুলিনবাবুরা নদী ভাঙন-আটকাতে কেন ব্যর্থ হলেন?” সিপিএম প্রার্থী পুলিনবাবুর পাল্টা জবাব, “কেন্দ্রের অসহযোগিতার জন্য এখানকার নদী-ভাঙন সমস্যাকে জাতীয় প্রকল্পের আওতায় আনা সম্ভব হয় নি।” তৃণমূলের জেলা কার্যকরী সভাপতি তথা জেলা পরিষদের সেচ কর্মাধ্যক্ষ নির্মল ঘোষ বলেন, “আমাদের সরকারই ভাঙন-রোধে নিবিড়-কর্মসূচি রূপায়ণের কাজ শুরু করেছে। নদী তীরবর্তী এলাকার ভোটারদের বিভ্রান্ত করার জন্য বিরোধীরা অপপ্রচার শুরু করেছে।”