অধরা লক্ষ্যমাত্রা।
শস্য বছর শেষ হতে চলল। অথচ, কৃষকদের কাছ থেকে ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রার এখনও অর্ধেকও সম্পূর্ণ করতে পারেনি জেলা প্রশাসন। ঠিক ছিল, এ বার পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় ৩ লক্ষ ২৮ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন ধান সংগ্রহ করা হবে। সেখানে এখনও পর্যন্ত হয়েছে মাত্র ১ লক্ষ ৩৮ হাজার মেট্রিক টন! ১ অক্টোবর থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়কালকেই রাজ্যে ধান কেনার বছর (শস্য বছর) হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। সেই হিসেবে আগামী মাস থেকেই শুরু হতে চলেছে নতুন শস্য বছর। প্রয়োজন মতো ধান কিনতে না পারার জন্য চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রাও অধরা থেকে গিয়েছে। ফলে, আগামী দিনে পশ্চিম মেদিনীপুরের মতো জেলায় সমস্যা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ব্যর্থতা এড়াতে রাজ্য সরকার আবার চালকল মালিকদের লেভির অতিরিক্ত চাল দিতে বাধ্য করছে বলে অভিযোগ উঠছে। শস্য বছর শেষ হতে চললেও ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেকও ছুঁতে পারা গেল না কেন? জেলা খাদ্য নিয়ামক পার্থপ্রতিম রায় বলেন, “এ বার লক্ষ্যমাত্রার থেকে কম ধান সংগ্রহ হয়েছে। তবে রাজ্যের অন্য জেলার থেকে পশ্চিম মেদিনীপুরের পরিস্থিতি খারাপ নয়।” পার্থপ্রতিমবাবুর দাবি, “জেলায় এ বার অভাবী বিক্রি হয়নি।” জেলায় যে পরিমাণ ধান উৎপাদন হয়, তার নামমাত্রই সহায়ক মূল্যে কেনে সরকার। এই পরিস্থিতিতে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়ায় চাষিদের মধ্যেও ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। পশ্চিম মেদিনীপুরে গত বছর আমন ধান উৎপাদন হয়েছে ২০ লক্ষ মেট্রিক টন। জানা গিয়েছে, গোটা রাজ্যেই এ বার ধান সংগ্রহ ধাক্কা খেয়েছে। চলতি শস্য বছরে রাজ্যে ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রা যেখানে ছিল ২২ লক্ষ মেট্রিক টন, সেখানে সংগ্রহ হয়েছে ১২ লক্ষ মেট্রিক টনের কাছাকাছি।
সাধারণত, অক্টোবর থেকে সরকারি উদ্যোগে ধান কেনা শুরু হয়। জেলা জুড়ে শিবির হয়। এ বার অবশ্য একটু দেরি করেই জেলায় সহায়ক মূল্যে ধান কেনা শুরু হয়েছিল। ফলে, অভাবী বিক্রি চলেছে বলে অভিযোগ। এ বার যেখানে সরকারি নির্ধারিত মূল্য অর্থাৎ, সহায়ক মূল্য ছিল কুইন্টাল প্রতি ১৩১০ টাকা, সেখানে চাষিরা ধান বিক্রি করেছেন ১১০০ থেকে ১১৫০ টাকার আশপাশে। অর্থাৎ, সহায়ক মূল্যের চেয়ে কমেই ধান বিক্রি হচ্ছে। অথচ, অভাবী বিক্রি রুখতেই চাষিদের কাছ থেকে সরাসরি ধান কেনে সরকার। এ জন্য ধানের মূল্যও বেঁধে দেওয়া হয়। ২০১১ সালে সহায়ক মূল্য ছিল ১০৮০ টাকা, ২০১২ সালে ১২৫০ টাকা, সেখানে ২০১৩ সালে সহায়ক মূল্য ১৩১০ টাকা করা হয়।
জেলার এক চালকল মালিকের কথায়, “সরকারি উদ্যোগে কখনও সমস্ত ধান কেনা সম্ভব নয়। এটা সকলেই বোঝেন। জেলায় যে পরিমাণ ধান উৎপাদন হয়, তার সবটা সরকার কিনে নেবে, এটা হতে পারে না। হয়ও না। তবে এটা ঠিক, সহায়ক মূল্যে ধান কেনায় গতি থাকলে খোলাবাজারে ধানের দাম দ্রুত পড়ে না। চাষিরাও ন্যায্য মূল্য পেতে পারেন। অন্তত, ধান বিক্রি করে তাঁদের ক্ষতির মুখ দেখতে হয় না।” এখন চাষের খরচ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। সার, কীটনাশকের দাম থেকে শ্রমিকদের মজুরি-সবই বাড়ছে। এই পরিস্থিতিতে খোলাবাজারে ধানের দাম একটু না বাড়লে বহু চাষি ক্ষতির শিকার হবেন। সহায়ক মূল্যে তড়িঘড়ি ধান কেনা না হলে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী কিংবা ফোড়ে চাষির কাছে পৌঁছে যায়। কম দামে ধান বিক্রি করতে বাধ্য করে। পরে সুযোগ বুঝে সেই ধান খোলাবাজারে বিক্রি করে তাঁরা ফুলেফেঁপে ওঠে। জেলায় কৃষকদের কাছ থেকে ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রা এখনও অর্ধেকও সম্পূর্ণ না হওয়ায় রাজনৈতিক চাপানউতোরও শুরু হয়েছে। জেলা পরিষদের প্রাক্তন সভাধিপতি অধুনা বিজেপি নেত্রী অন্তরা ভট্টাচার্যের মতে, “সহায়ক মূল্যে ধান কেনায় সরকারের সদিচ্ছার অভাব ছিল। তাই এই পরিস্থিতি। অভাবী বিক্রি রুখতে সরকার সেই ভাবে পদক্ষেপই করেনি। ফলে, অনেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।” জবাবে মেদিনীপুরের বিধায়ক তথা জেলা তৃণমূলের চেয়ারম্যান মৃগেন মাইতি বলেন, “আগের সরকারের আমলে চাষিরা ন্যায্যা দাম পেতেন না। ফলে, অভাবি বিক্রি হত। এখন সেই পরিস্থিতি নেই।” জেলা পরিষদের কৃষি কর্মাধ্যক্ষ তথা জেলা তৃণমূলের কার্যকরী সভাপতি নির্মল ঘোষও বলেন, “আগে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী কৃষকদের কাছে পৌঁছত। কম দামে ধান বিক্রি করতে বাধ্য করত। এখন তা হয় না।”