পূর্বপুরুষের স্মৃতিচারণেই দেবী আরাধনা জঙ্গলমহলে

কোথাও দেবী অস্ত্ররূপে পূজিতা হন, কোথাও মাটির হাতি-ঘোড়ার ‘ছলনে’ তাঁর আরাধনা। কোথাও আবার পূর্ব পুরুষের স্মৃতিতে শোকযাপন। জঙ্গলমহলের লোকায়ত শারদোৎসবে বৈভব নেই। কিন্তু বাগদি, শবর ও অন্ত্যজদের দেবী-আরাধনায় রয়েছে হৃদয়ের আকুতি। হয়তো রয়েছে আর্য-অনার্যের চিরকালীন দ্বন্দ্বের প্রতিফলনও! পশ্চিম মেদিনীপুরের বেলিয়াবেড়ার ভোল গ্রামের লোকায়ত পুজোয় দেবী ‘অস্ত্ররূপেণ সংস্থিতা’।

Advertisement

কিংশুক গুপ্ত

ঝাড়গ্রাম শেষ আপডেট: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:৪৯
Share:

পুজোর চারদিন ব্রাত্য শবর সম্প্রদায়ের নিত্য পূজারি। —নিজস্ব চিত্র।

কোথাও দেবী অস্ত্ররূপে পূজিতা হন, কোথাও মাটির হাতি-ঘোড়ার ‘ছলনে’ তাঁর আরাধনা। কোথাও আবার পূর্ব পুরুষের স্মৃতিতে শোকযাপন। জঙ্গলমহলের লোকায়ত শারদোৎসবে বৈভব নেই। কিন্তু বাগদি, শবর ও অন্ত্যজদের দেবী-আরাধনায় রয়েছে হৃদয়ের আকুতি। হয়তো রয়েছে আর্য-অনার্যের চিরকালীন দ্বন্দ্বের প্রতিফলনও!

Advertisement

পশ্চিম মেদিনীপুরের বেলিয়াবেড়ার ভোল গ্রামের লোকায়ত পুজোয় দেবী ‘অস্ত্ররূপেণ সংস্থিতা’। প্রায় চারশো ঘর বাগদির ওই গ্রামে একজোড়া প্রাচীন তরবারিকেই দুর্গারূপে পুজো করা হয়। ভোল গ্রামের প্রান্তিক চাষি কানাই দিগারের কুঁড়ে ঘরের মাটির বেদিতে থাকা ওই দু’টি তরবারি উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া। পুরুষানুক্রমে তরবারি দু’টি এখন রয়েছে কানাইবাবুর হেফাজতে। কানাইবাবু জানালেন, তাঁর পূর্বপুরুষেরা স্থানীয় জমিদাররের পাইক ছিলেন। জঙ্গলমহলে ‘চুয়াড় বিদ্রেহ’এর সময় বাগদিদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। কানাইবাবুর চতুর্থ পুরুষ ওই তরবারি নিয়ে ভূমিস্বামীর জমি উদ্ধার করতে গিয়ে প্রতিপক্ষের সঙ্গে লড়াই করে নিহত হন। শারদোৎসবের চারদিন তরবারি-পুজোকে ঘিরে মেলা বসে।

বেলিয়াবেড়ার বালিপাল গ্রামে আবার স্তূপীকৃত পোড়ামাটির হাতিঘোড়ার ‘ছলনে’ দুর্গার আরাধনা করেন বাগদি সম্প্রদায়ের ‘দেহরি’ (পূজারি)। লোকশ্রুতি, দেবীর স্বপ্নাদেশে কেঁদুগাছের জঙ্গলে দেবীর পুজো শুরু হয়েছিল বলে এখানে দেবীর নাম ‘কেঁদুয়া’। কিছুটা দূরে শাস্ত্রীয় দুর্গাপুজো হলেও আদি পুজোটি হয় লোকায়ত নিয়মে। আজও এই পুজোয় দেহরি নিজের শরীরের রক্ত নিবেদন করেন দেবীকে। জনশ্রুতি, বর্গি হামলার সময় স্থানীয়রা বীরত্বের সঙ্গে লড়েছিলেন অনেকে নিহত হন। লোক সংস্কৃতি গবেষকদের ধারণা, পূর্ব পুরুষদের স্মৃতিতেই রক্তাঞ্জলির এমন উপাচার।

Advertisement

জামবনির সানগ্রাম ও যুগিবাঁধ গ্রামের লাগোয়া শালবীথির মাঝে পোড়া মাটির হাতিঘোড়ায় প্রতীকী ভাবে ‘দুর্গাবুড়ি’ নামে দেবী পূজিতা। পুজো করেন শবর দেহরি। হতদরিদ্র শবর সম্প্রদায়ের মতো দুর্গাও এখানে দুয়োরানি। জনশ্রুতি, এখন যেখানে চিল্কিগড়ের কনকদুর্গা মন্দির, আড়াইশো বছর আগে সেখানেই ছিল শবর সম্প্রদায়ের বাসভূমি। জামবনি পরগনার সামন্ত রাজা গোপীনাথ সিংহ মত্তগজ দেবী কনকদুর্গার মন্দির নির্মাণ করলে শবরদের সরে যেতে হয়। বিতাড়িত হয়ে শবরেরা পরে সানগ্রামের কাছে গহীন জঙ্গলে ঘর বাঁধেন। তাঁদের ‘গরামদেবী’ (গ্রামের দেবী) দুর্গাবুড়িকে সেখানে স্থাপন করা হয়। মহাষ্টমীর দিনে দুর্গাবুড়ির পুজো করেন দেহরি।

সাঁকরাইলের তালাই গ্রামের লাগোয়া দেবী জয়চণ্ডীর থান। জঙ্গলাকীর্ণ এক জনহীন প্রান্তরে রয়েছে জয়চণ্ডীর মন্দির। শিলাময়ী দেবী জয়চণ্ডীর পুজো হয় লোকায়ত নিয়মে। দুর্গাপুজোর চারটে দিন বাদে সারা বছর পুজো করেন শবর সম্প্রদায়ের ‘দেহরি’। কিন্তু শারদীয় দুর্গাপুজোর সময় শবরেরা ব্রাত্য হয়ে যান। তখন মন্দিরের দখল নেন উপবীতধারী ব্রাহ্মণ। ঝাড়গ্রামের লোক সংস্কৃতি গবেষক সুব্রত মুখোপাধ্যায় বলেন, “উপজাতীয় সংস্কৃতির উপর ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির আগ্রাসনের এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত জয়চণ্ডীর বার্ষিক শারদোৎসব। সারা বছর যাঁরা দেবীর সেবা করেন, দুর্গাপুজোর চারটি দিন সেই শবরেরা কেবল বলিদানের দায়িত্ব পালন করেন।”

বিজয়া দশমীতে চোখের জলে দেবীকে বিদায় জানায় বাঙালি। কিন্তু এই সময় জঙ্গলমহলে অন্য এক দুর্গার শোকে ভূয়াং নামে প্রতীকী বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে ‘দাঁশায়’ নাচেন সাঁওতাল পুরুষেরা। পুরাকথা অনুযায়ী, আশ্বিনের শুক্লপক্ষের দশমী তিথিতে ‘হুদুড় দুর্গা’ নামে পরাক্রমী এক মূলবাসী রাজাকে কৌশলে বধ করেছিলেন এক আর্যনারী। সেই থেকে আদিবাসীদের কাছে দশমী তিথিটি শোক-যাপনের দিন। নাচের সঙ্গে গানের ছত্রে থাকে ‘হায়রে হায়রে’ বিলাপের সুর।

জঙ্গলমহলের শারদোৎসব প্রকৃত অর্থেই মূলবাসীদের কাছে পূর্বপুরুষের বীরগাথা ও আত্মত্যাগের স্মৃতিযাপন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement