বন্যা দুর্গতদের জন্য রাজ্য সরকারের আর্থিক সহায়তায় নির্মিত আশ্রয় কেন্দ্র বেসরকারি একটি হোটেলকে লিজে ভাড়া দেওয়ার অভিযোগ উঠল।
রাজ্য সরকারের বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের আর্থিক সহায়তায় বছর ছ’য়েক আগে ‘উজান’ নামে ওই দুর্যোগ কেন্দ্রটি তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু উদ্বোধনের বছরখানেকের মধ্যে একটি বেসরকারি ভ্রমণ সংস্থাকে ৩২ লক্ষ টাকার বিনিময়ে ওই কেন্দ্রের ভবন লিজ দেওয়া হয়। চার তলা ওই ভবনের এক তলা দুর্গতদের আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে রাখা হলেও বাকি তিনটি তলা চার বছরের জন্য লিজ দেওয়া হয়েছে। এখন সেখানেই ‘উন্নয়ন সাগর’ নামে একটি হোটেল চলছে। ২০১১ সালের ২২ জুলাই রামনগর পঞ্চায়েত সমিতি ও ওই বেসরকারি ভ্রমণ সংস্থার মধ্যে চুক্তিটি সম্পাদিত হয়। চুক্তিপত্র সম্পাদনের সময়ই রামনগর-১ পঞ্চায়েত সমিতি তিনটি ব্যাঙ্ক ড্রাফটের মাধ্যমে ৩২ লক্ষ টাকা নিয়েও নেয়।
সরকারি অর্থে তৈরি আশ্রয়কেন্দ্র এভাবে বেসরকারি সংস্থার কাছে মোটা টাকার বিনিময়ে লিজ দেওয়াকে কেন্দ্র করে প্রশাসনের অন্দরে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। প্রশাসনের একাংশের মতে, পঞ্চায়েত সমিতির নিজেদের সম্পদ লিজ দেওয়ার অধিকার রয়েছে। তবে ওই আশ্রয়কেন্দ্রের জমি দিঘা-শঙ্করপুর উন্নয়ন পর্ষদের মালিকানাধীন। তাই সরকারি অর্থে নির্মিত দুর্গতদের আশ্রয়কেন্দ্রের চরিত্র পরিবর্তন করে সেখানে বসরকারি হোটেল চালানোর অনুমতি দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, রাজ্য সরকারের অডিট দফতরের ‘উজান’ সংক্রান্ত অডিট নিয়ে প্রশ্নের উত্তরে বিডিও তমোজিত্ চক্রবর্তী লিখিতভাবে জানিয়েছেন, পঞ্চায়েতের বিভিন্ন প্রকল্পের টাকা নিয়েই ‘উজান’ তৈরি হয়। বর্তমানে অস্থায়ীভাবে ওই আশ্রয় কেন্দ্র অন্যভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের অর্থে ওই আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি হলেও ওই কেন্দ্রে হোটেল চালানোয় দফতরের কোনও স্বীকৃতি বা অনুমোদন নেওয়া হয়নি। চুক্তিপত্রে সাক্ষরকারী ব্লকের তত্কালীন বিডিও রানা বিশ্বাসের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। রামনগর-১ পঞ্চায়েত সমিতির বতর্মান সভাপতি ও তত্কালীন পূর্ত কমাধ্যক্ষ নিতাইচরন সার জানান, উজানের এক তলা ভবন নির্মাণের জন্য বিপর্যয় মোকাবিলা দফতর থেকে ৮ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করা হয়। বতর্মানে ওই কেন্দ্রের একতলাটি দুর্গত মানুষদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য ফাঁকাই রাখা রয়েছে। তাই ভবনের ওই অংশ লিজ দেওয়া হয়নি। তিনি আরও জানান, যেহেতু ৮ লক্ষ টাকায় ওই একতলা ভবনের কাজ করা সম্ভব ছিল না। তাই পঞ্চায়েত সমিতি ওই অর্থের সঙ্গে বিভিন্ন প্রকল্প থেকে অর্থ বরাদ্দ করে আশ্রয়কেন্দ্রের চার তলা ভবনটি তৈরি হয়।
পঞ্চায়েত সমিতি সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০০৮ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি রাজ্যের বিপর্যয় মোকাবিলা দফতর রামনগর-১ ব্লকের বিলামুড়িয়া মৌজার ৮৫৫ নম্বর প্লটে দুর্গত মানুষদের জন্য আশ্রয় কেন্দ্র গড়তে ৮ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করে। তবে ওই প্লটটি দিঘা-শঙ্করপুর উন্নয়ন পর্ষদের এলাকাভুক্ত। তাই পঞ্চায়েত সমিতির পক্ষ থেকে পর্ষদের কাছে ‘নো অবজেকশন’ চাওয়া হয়। পর্ষদ ওই বছরের ২৯ অক্টোবর ‘নো অবজেকশন’ ও আশ্রয় কেন্দ্রের দোতলা ভবন তৈরির অনুমোদন মঞ্জুর করে। যদিও তার আগেই ২০০৮ সালের ১৫ অগস্ট ‘উজান’ বহুমুখী আশ্রয় ও প্রশিক্ষণ ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন জেলা গ্রামোন্নয়ন কেন্দ্রের প্রকল্প অধিকর্তা পার্থসারথি তলাপাত্র ও দিঘা-শঙ্করপুর উন্নয়ন পর্ষদের নির্বাহী আধিকারিক শ্যামল মণ্ডল। ওই অনুষ্ঠানে ছিলেন রামনগরের তত্কালীন বিধায়ক স্বদেশ নায়ক, পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি দেবব্রত দাস, বিডিও উজ্জ্বল সেনগুপ্ত।
প্রশাসনিক সূত্রে জানা গিয়েছে, ওই আশ্রয়কেন্দ্র তৈরির জন্য বরাদ্দ ৮ লক্ষ টাকার বেশি অর্থ ব্যয় হয়। ফলে ওই কাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত ঠিকাদারদের টাকা বকেয়া পড়ে যায়। ২০০৯ সালে পঞ্চায়েত সমিতির অর্থ সংক্রান্ত স্থায়ী সমিতির বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, আশ্রয় কেন্দ্রটিকে বহুমুখী আশ্রয় ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে গড়তে চার তলা ভবন তৈরি করা হবে। সেখানে দুর্গতদের আশ্রয় দেওয়া ছাড়াও সরকারের বিভিন্ন দফতর ও সংস্থার কর্মী-সহ স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলাদের প্রশিক্ষণ শিবির আয়োজন করা হবে। ওই ভবনে রাত্রিবাসের ব্যবস্থাও থাকবে। ওই প্রকল্পে বাড়তি অর্থের সংস্থান করতে পঞ্চায়েতের বিভিন্ন প্রকল্প থেকে অর্থের জোগান দেওয়ার কথা হয়। জেলা পরিষদ ‘উজান তহবিল’ নামে ১০ লক্ষ টাকা মঞ্জুর করে। তাছাড়াও অডিট রির্পোট অনুযায়ী ওই প্রকল্পে ‘বিআরজিএফ’, দ্বাদশ অর্থ কমিশন, স্বর্ণজয়ন্তী স্ব-রোজগার যোজনা, তৃতীয় রাজ্য কমিশন, নিশর্ত তহবিল ও পঞ্চায়েতের নিজস্ব তহবিলের মোট ৭২ লক্ষ ৩২ হাজার ৩০৬ টাকা ব্যয় করা হয়। এবিষয়ে রামনগর-১ ব্লকের বিডিও তমোজিত্ চক্রবর্তীকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “বিষয়টি নিয়ে উচ্চ পর্যায়ের প্রশাসনিক তদন্ত চলছে। তাই এনিয়ে কিছু বলব না।”